গোলাম মোহাম্মদ কাদের |

প্রকাশ : বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রজাতন্ত্র অর্থ হলো এমন একটি দেশ, যেখানে চূড়ান্ত ক্ষমতার মালিক সমগ্র জনগণ, সেই জনসমষ্টির হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের বিভিন্ন পন্থা আছে।

প্রথম দিকে একটি সহজ সরল পদ্ধতি সর্বত্র ব্যবহৃত হতো। ইচ্ছুক প্রার্থীদের মধ্য থেকে যার সমর্থন বেশি তিনি প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন। এ পদ্ধতিকে প্লুরালিটি মেজরিটি ভোটিং সিস্টেম বলা হয়।

অল্প কিছু দিনের মধ্যে এ পদ্ধতির নেতিবাচক দিকসমূহ প্রকাশ পাওয়া শুরু হলো।   দেখা গেল এ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হওয়া প্রতিনিধি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের প্রতিনিধি হচ্ছেন না। দুজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে, যে কোনো একজন শতকরা ৫০% এর সামান্য বেশি মানুষের সমর্থনে নির্বাচিত হতে পারেন। কিন্তু শতকরা ৪৯% মানুষ সে ক্ষেত্রে নির্বাচিত মানুষটিকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে পান না। ভোটের মাধ্যমে দেওয়া তাদের মতামতটি গুরুত্ব পাচ্ছে না বিধায় নষ্ট হচ্ছে। প্রার্থীর সংখ্যা বাড়লে আরও অধিক সংখ্যার জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে ব্যর্থ হচ্ছেন।

দেখা যায়, উপরোক্ত কারণে বা নানাভাবে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। যেমন এতে করে, প্রায়শ সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রতিনিধিত্বকারী সরকার গঠিত হয়। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দলসমূহের প্রতিনিধিত্বকারী ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মভিত্তিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকে না বললেই চলে। তাছাড়া প্রার্থীরা এলাকাভিত্তিক হন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরাসরি স্বার্থ জড়িত থাকার কারণে প্রার্থীদের মধ্যে নিজ নিজ এলাকায় দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়াস থাকে। সে কারণে ভোট ও ফলাফলে অনেক ধরনের অনিয়ম ও হতাহতের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।

এ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতি এক পর্যায়ে বৃহৎ আদর্শের পরিমণ্ডলে দুভাগে বিভক্ত হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র ক্রমান্বয়ে দুই দলভিত্তিক রাজনৈতিক মডেলে রূপান্তরিত হয়। সাধারণত মধ্য থেকে বাম বা উদারপন্থি ও মধ্য থেকে ডান বা রক্ষণশীল দলসমূহের দুই প্রতিপক্ষ জোট গঠিত হয়। দুই জোটের ক্ষুদ্র দলগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়। পরবর্তীতে ওইসব দল বিলীন হয়ে যায় ও সমর্থকরা কোনো এক পর্যায়ে এ দুই জোটের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলসমূহে ঠিকানা হারায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থীসমূহ নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলিত আছে। ওইসব দেশে জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন প্রধানত ওই ধরনের দুটি বৃহৎ দল বা তাদের নেতৃত্বাধীন গঠিত দুটি জোটের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে ওই ধরনের দুই জোটের অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র দলসমূহ প্রায় ক্ষেত্রেই জোটে নেতৃত্বদানকারী দলের নির্বাচনী প্রতীক ব্যবহার করে থাকে।

এ অবস্থার প্রেক্ষিতে, প্রোপরশনাল রিপ্রেজেনটেশন ভোটিং সিস্টেম নামে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন পদ্ধতির প্রচলন করা হয়। পূর্ব বর্ণিত পদ্ধতির দুর্বলতাসমূহ বহুলাংশে দূরীভূত হয়। তবে এ পদ্ধতিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়। কোয়ালিশন সরকার অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়। আবার কোয়ালিশন সরকারের জবাবদিহিতা সাধারণত উন্নততর হয়।

 

 

এসব কারণে পশ্চিমা দেশসমূহ নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রতিদিন অধিক সংখ্যায় অনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব (পিআর) ভোটিং পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে। পশ্চিম ইউরোপের ২৮টি দেশের মধ্যে ২১টি দেশে বর্তমানে এ নতুন পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে।

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণে সব নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয় একসঙ্গে। দেশের সব ভোটার ব্যালটের মাধ্যমে তার পছন্দের দলকে সমর্থন জানান। যে দল দেশব্যাপী মোট গৃহীত ভোটের যত শতাংশ সমর্থন লাভ করবে মোট আসনের তত শতাংশ আসনে সে দলীয় সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বলে গণ্য হবেন। দলসমূহ গুরুত্বের ক্রম অনুসারে সব আসনের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নামের তালিকা আগেই প্রকাশ করবে। গৃহীত সমর্থনের অনুপাতে দলসমূহ হতে ক্রম অনুসারে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা লভ্য আসন সংখ্যা পূরণ করতে হবে। ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে যদি কোনো দল দেশব্যাপী সংগৃহীত মোট ভোটের ৫০% লাভ করে তবে ৩০০ আসনের শতকরা ৫০ ভাগ অর্থাৎ ১৫০টি আসনে জয়লাভ করেছেন বলে ধরা হবে। একক পার্লামেন্ট নির্বাচনে ২০% সমর্থন যে দল লাভ করবে তারা ৬০টি আসনে বিজয়ী হিসেবে গণ্য হবেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যারা কাজ করেন তারা আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব (পিআর) অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। তবে প্রধানত তিন ধরনের পদ্ধতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন— (১) পার্টি লিস্ট  (২) মিক্সড মেম্বার, (৩) সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট।

পার্টি লিস্ট টাইপ পিআর ভোটিং পদ্ধতি সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক দল মোট আসন সংখ্যার সমপরিমাণ প্রার্থীদের তালিকা দেবেন। নির্দলীয় প্রার্থীরাও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলসমূহের সঙ্গে নির্দলীয় প্রার্থীদের নাম ব্যালটে এমনভাবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে যে তারা নিজেরাই তাদের দল।

পার্টি লিস্ট পদ্ধতি আবার দুই প্রকার, ‘কোজড লিস্ট’ এবং ‘ওপেন লিস্ট’। এখানে দল যে প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করবে দল সে তালিকায় কোন প্রার্থীর অবস্থান কোথায় হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে দেবে। ভোটাররা তাদের পছন্দের দল/নির্দলীয় প্রার্থীর অনুকূলে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান করবেন। সব দল মোট প্রদত্ত ভোটের যত ভাগ লাভ করবে, সে অনুপাতে পার্লামেন্টে আসন দেওয়া হবে। দল কর্তৃক প্রদত্ত তালিকার মধ্য হতে ক্রম অনুসারে প্রার্থীদের দ্বারা বিজয়ী আসনসমূহ পূর্ণ করা হবে। কোজড লিস্ট পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের অবস্থানের ক্রম পরিবর্তনে ও সে কারণে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। ওপেন লিস্ট পদ্ধতির পিআর ভোটিং শুধু কোনো দলের আনুপাতিক অবস্থানই নয়, তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের ক্রম অনুসারে অবস্থান, ভোটারদের ভোটে নির্ধারিত হয়।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলসমূহের এবং নির্দলীয় প্রার্থীসমূহের মধ্যে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টনের জন্য বিভিন্ন ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে সহজতর ও বহুল ব্যবহৃত ফর্মুলার নাম ‘লারজেস্ট রিমেইন্ডার ফর্মুলা’ যা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় বৃহত্তম অবশিষ্ট ভিত্তিক নির্ণয় ফর্মুলা।

মিক্সড মেম্বার প্রোপরশনাল রিপ্রেজেনটেশন বস্তুত প্লুরালিটি মেজরিটি (বাংলাদেশের বর্তমান ভোটিং ব্যবস্থা) ও প্রোপরশনাল ভোটিং সংমিশ্রণ এ সৃষ্ট একটি পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়াটিকে ‘জার্মান সিস্টেম’ নামেও অভিহিত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় ভৌগোলিকভাবে, নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব ও নৈকটত্ব যেমন গুরুত্ব পায়, একইভাবে পিআর ভোটিংয়ের বহুমাত্রিকতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।

এ পদ্ধতিতে দুই অংশবিশিষ্ট ব্যালট ব্যবহার করা হয়। ভোটাররা একটি অংশে এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ভোট দেন। সাধারণত মোট আসনের অর্ধেক সংখ্যার জন্য এভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। অন্য অংশে ভোটাররা তাদের পছন্দের দলের পক্ষে ভোট দেন। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে দলগুলোর মধ্যে দেশব্যাপী মোট আসনের ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়। পিআর ভোটের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা পূর্ণ করার জন্য যে দল এলাকাভিত্তিক যতগুলো আসন পেয়েছে তার সঙ্গে ওই দলের পার্টি লিস্ট থেকে ক্রম অনুযায়ী দলীয় প্রার্থীদের জন্য আসন বণ্টন করা হয়।

সিঙ্গল ট্রান্সফারেবল ভোট সিস্টেম (এসটিভি)-কে চয়েস ভোটিংও বলা হয়। সব প্রার্থীর নাম ব্যালটের একই স্থানে লিপিবদ্ধ থাকবে। ভোটাররা যে কোনো একজনকে ভোট না দিয়ে সব প্রার্থীর স্থলে পছন্দের ক্রম জানাবেন। ‘ট্রান্সফারেবল’ (বদলিযোগ্য) অর্থাৎ ভোটসমূহ এক প্রার্থী থেকে আর এক প্রার্থীর কাছে পছন্দের ক্রম অনুসারে দরকার মতো স্থান পরিবর্তন করতে পারবে। আসন বণ্টন প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট জটিল। তবুও ব্যবহার করা হয় অনেক স্থানে। কারণ এসটিভি পদ্ধতি সবচেয়ে সঠিক আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে ও এতে নষ্ট ভোটের সংখ্যা সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের পরোক্ষ নির্বাচন এসটিভি পদ্ধতিতে পরিচালনার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অনেকে প্রধান দুটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রাজনীতি ও শাসনে বীতশ্রদ্ধ। তারা এর বাইরে তৃতীয় শক্তির উত্থানের প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশের মানুষ ‘বহু দলীয়’ গণতন্ত্রের পক্ষে। উপরে বর্ণিত ব্যাখ্যা থেকে বলা যায়, বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা ও ফলশ্রুতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থানের বাধা বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি। এখানে প্রধান দুটি ধারার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে নেতৃত্বকারী দল পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু দুই প্রধান ধারার বাইরে বিকল্প তৃতীয় ধারার শক্তি আত্মপ্রকাশ করতে পারবে বলে মনে হয় না। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃতীয় ধারা সৃষ্টির প্রয়াস বাস্তবসম্মত নয়।

বাংলাদেশের বতর্মান নির্বাচন পদ্ধতির ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিবেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মুক্তিযুদ্ধের ফসল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। ‘গণতন্ত্রকে’ এ দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার দিশারী হিসেবে গণ্য। জনগণ সবাই দেশের সর্বময় ক্ষমতার মালিক। রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সে কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ ইত্যাদি সব ধরনের গণগোষ্ঠীর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে থাকতে হবে।

প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি লব্ধ ফলাফলে এ বিষয়সমূহের ব্যাপক ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে।   নির্বাচন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন ভোটিং পদ্ধতির প্রচলন কাঙ্ক্ষিত বিষয়সমূহ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।   পার্টি লিস্ট, ওপেন টাইপ, পিআর ভোটিং পদ্ধতির বিষয় বিবেচনা করা যায়।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও কো-চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।