একান্ত সাক্ষাৎকারে জিএম কাদের
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০:০০ । যুগান্তর
তিনশ’ আসনে এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি চলছে, তবে দল কোনো জোটে যাবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন পার্টির চেয়ারম্যান
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অনিশ্চিত এবং অস্থির। বিষয়টি বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান মনে না হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, এই অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। সামগ্রিক পরিস্থিতিকে একবাক্যে বলা যেতে পারে ‘ঝড়ের’ পূর্বাভাস। ঝড়ের কারণে সমুদ্র যেমন ক্রমশ উত্তাল হয়ে ওঠে। আমাদের রাজনৈতিক সমুদ্রও দিন দিন উত্তাল হয়ে উঠছে। এর মধ্য দিয়েই পাড়ি দিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। এ ঝড়ের মধ্য দিয়ে আমরা সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছি। পরিণতি কি হবে কেউ জানে না। সম্প্রতি যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
তিনি আরও বলেন, এ ঝড় প্রশমন করতে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় তা দেখার বিষয়। তারা কি যার যার অবস্থানে অনড় থাকবে, না-কি দেশের ভবিষ্যৎ ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থে কিছুটা হলেও নমনীয় হবে- এটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও এখন পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থে তেমন কোনো উদ্যোগ মানুষের চোখে ধরা পড়েনি। অতীত অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ ঝড় মোকাবেলার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা এমনিতেই একটি জনবহুল দেশ, আমাদের সম্পদ সীমিত। তাই গণতন্ত্রই আমাদের শেষ ভরসা।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই জিএম কাদের একসময় সরকারি চাকরি করতেন। অবসর নিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে পা দেন জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে। এরই মধ্যে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। দলের এবং দলের বাইরে সবার কাছে ক্লিন ইমেজের জিএম কাদের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ, দলের অন্যতম একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
আগামী নির্বাচন সম্পর্কে জিএম কাদের বলেন, আমি এখনও মনে করি, এমনকি বিশ্বাসও করি, আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণেই অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি আবারও নির্বাচন বর্জনের মতো ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না। ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন এ দেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আমি অন্তত মনে করি না। তবে নির্বাচনে কোন দল অংশ নিল আর কোন দল অংশ নিল না, তার চাইতেও বড় কথা হল- নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন কতটা ঘটল। জনগণের সম্পৃক্ততা কতটা থাকল। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে ভোট দিল কিনা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে এসব প্রশ্নের উত্তর জানাটা বড় বিষয়।
তিনি বলেন, যদিও প্রধান দুই প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যার যার অবস্থানে অনড়। আওয়ামী লীগ বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংকল্পবদ্ধ। বিএনপি বলছে, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। দুই দলের এই দ্বিমুখী অবস্থানের কারণে আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে সংশয়-সন্দেহ এবং উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এ সংশয়-সন্দেহ এবং উদ্বেগ কোথায় গিয়ে শেষ হয় কেউ তা বলতে পারছে না। জনগণ মনে করে, সংশয়-সন্দেহ এবং উদ্বেগ দূর করার চাবি এই দুই দলের হাতেই। বৃহত্তর স্বার্থে তারা যদি যার যার অবস্থান থেকে একটু করে ছাড় দেয়, তাহলেই দেখা মিলবে আশার আলো। তা না হলে দেশ সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে পারে।
মানুষের মাঝে হাজারও প্রশ্ন- এমন দাবি করে জিএম কাদের বলেন, নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে কিনা; সব দল এ নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা; নির্বাচনের আগ মুহূর্তে, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কি কি ঘটতে পারে; এর মধ্য দিয়ে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে; রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ভালো না খারাপের দিকে যাবে; অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বিনিয়োগের অবস্থা কি হবে; শিল্পায়ন হবে কিনা; বেকারত্ব বাড়বে কিনা; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আরও ঊর্ধ্বগতি হবে নাকি এর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে- এরকম হাজারও প্রশ্ন এখন মানুষের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না বলেই সর্বত্র অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে।
শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বর্তমান অবস্থা কেমন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে অন্তর্দ্বন্দ্বসহ তারা এখন নানা সমস্যায় নিমজ্জিত। আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতাকর্মীর নানা ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে দলটির জনসমর্থনেও অনেকটা ভাটা পড়েছে। তাই বলে বিএনপির অবস্থা ভালো, এমনটাও ঠিক না। বিএনপির অবস্থা আরও খারাপ। তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ সংকট প্রকট। অথচ দলটি দাবি করছে, তাদের জনসমর্থন রয়েছে, দিন দিন জনসমর্থন বাড়ছে। কিন্তু এই দাবির পক্ষে কোনো বাস্তব যুক্তি তারা দিতে পারছে না। বরং বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি নাবিকবিহীন নৌকার মতো লক্ষ্যহীন পথে চলছে।
এই দুইয়ের মধ্যে জাতীয় পার্টির অবস্থা কি- এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, আমাদের পার্টি যে সুখকর অবস্থায় রয়েছে, এমনটাও দাবি করি না। তবে দলের অবস্থাও খারাপ না। কিন্তু এটা সত্য যে, জাতীয় পার্টি একটি আলাদা বড় রাজনৈতিক দল। এ দলের নিজস্ব শক্তি, সামর্থ্য ও রাজনীতি রয়েছে, তা মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টিকে তার রাজনীতি ঠিক করতে হবে। অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। জাতীয় পার্টি নয় বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। অনেক অনেক কাজ হয়েছে ওই নয় বছরে। এর পরের সরকারগুলোও কাজ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে এখনও জাতীয় পার্টির শাসনামলই ছিল শ্রেয়। এ বাস্তবতাকে মাথায় রেখে জাতীয় পার্টিকে এগিয়ে যেতে হবে।
আগামীতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কি হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, সাধারণ মানুষ মনে করে জাতীয় পার্টির নিজস্ব কোনো রাজনীতি নেই। জাতীয় পার্টি না সরকারি দল, না বিরোধী দল। দলটির নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই। ফলে এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে পার্টিকে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আর এ প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই প্রথমে দলের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করার পাশাপাশি দলকে গোছাতে হবে। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে পার্টিকে তৃণমূল পর্যন্ত ঢেলে সাজাতে হবে। যারা নিষ্ক্রিয় তাদের সক্রিয় করতে হবে। তরুণদের এগিয়ে আনতে হবে। তাদের কাজে লাগাতে হবে।
তিনি বলেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করতে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি সামগ্রিক পরিস্থিতি গভীর পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে সজাগ ও সতর্ক থাকার পাশাপাশি পার্টির ভেতরে যে কোনো মূল্যে একতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। দলের ভেতরে যাদের অবস্থান এবং ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে- তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ আনুগত্য নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতায় এলে দল কি করবে, লক্ষ্য ও কর্মসূচি কি হবে- এসব এখন থেকেই ঠিক করতে হবে। জাতীয় পার্টির স্বার্থে সবকিছু ঠিকঠাক করতে হবে। কাজগুলো করতে পারলে আগামী নির্বাচনে পার্টি অবশ্যই চমক দেখাতে সক্ষম হবে।
জিএম কাদের বলেন, যদিও ইতিমধ্যে এ কাজটি শুরু হয়েছে। বিভিন্ন আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঠ ও দল গোছানোর নির্দেশনা দিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান চিঠি দিচ্ছেন। তারা ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। পার্টির শীর্ষ নেতারাও জেলায় জেলায় সফরে যাচ্ছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দলকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। মূলত আগামী নির্বাচনকে ঘিরেই জাতীয় পার্টির সামগ্রিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এ প্রস্তুতি আরও জোরেশোরে শুরু করতে হবে। তিনি মনে করেন, রাজনীতির সুফল ঘরে তুলতে চাইলে জনগণের মনের ভাষা বুঝতে হবে। জনগণ কি চায় তা জানার চেষ্টা করতে হবে।
এককভাবে না জোটগতভাবে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এককভাবেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছি। ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেব। প্রার্থী কারা হবেন, তা দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠকে ঠিক করা হবে। জোটে যাওয়ার বিষয়টি নির্বাচনকালীন সময়ের বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান ঠিক করবেন। এ ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।