সাক্ষাৎকার : গোলাম মোহাম্মদ কাদেরআগামী নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্তের সময় এখনও হয়নিসাক্ষাৎকার গ্রহণ: এহ্সান মাহমুদগোলাম মোহাম্মদ কাদের সমধিক পরিচিত জি এম কাদের নামে। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা। জি এম কাদের ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে বাণিজ্য এবং বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল প্রকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পেশাগত জীবনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে পরিচালক হিসেবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৪৮ সালে।সমকাল: জাতীয় পার্টির প্রধান হিসেবে আপনার দায়িত্ব পরিচালনার ওপর আদালতের নির্দেশনা সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নির্ধারণে এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?জিএম কাদের: আমি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও খবর নিয়েছিলাম। জানতে পেরেছি, শুধু আরেকটি দেশে এমন ঘটনা ঘটেছিল। এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে, আমরা যেটাকে বলি সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি; এমনটা ঘটতে থাকলে তা বাধাপ্রাপ্ত হয় বলেই দেখা গেছে। যেখানে গণতন্ত্রের যথাযথ চর্চা হয়, সেখানে এমনটা হয় না।সমকাল: বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বাইরে সংসদে রাজনৈতিক দল আছে মাত্র জাতীয় পার্টি। বিএনপির সংসদ সদস্যরা আগামী নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবিসহ আরও কিছু দাবিতে পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না। এমন অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে জাতীয় পার্টির অবস্থান জানতে চাই।জি এম কাদের: দলীয় সরকারের অধীনে পৃথিবীর অনেক দেশেই নির্বাচন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার ব্যবস্থা এমন একটি কাঠামোতে এসে দাঁড়িয়েছে, যেটাকে ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকার বলা যায়। ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে সবকিছু দলীয়করণ করা হচ্ছে এবং দলীয় বিবেচনায় হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে সংবিধানের কিছু দুর্বল বিষয়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানে পরিবর্তন এনে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে, যেখানে নির্বাহী বিভাগের হাতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি কোনো নির্বাচন হয় এবং সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে অন্য কারও জয়ী হওয়ার আর সুযোগ থাকছে না।সমকাল: এ পরিস্থিতিতে কী করণীয়?জিএম কাদের: এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে কিছু পদ্ধতি নেওয়া যেতে পারে। সে জন্য সংবিধানে অতিপ্রয়োজনীয় কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সরকারি দলের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দরকার। নইলে এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া ভবিষ্যৎ অন্ধকার। জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা না করার ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা; জনগণের মালিকানার যে অধিকার, সেখান থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি। এতে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে লক্ষ্য ছিল স্বাধীন প্রজাতন্ত্র, যার মালিকানা থাকার কথা দেশের জনগণের হাতে এবং সরকার গঠন করার কথা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের নিয়ে; সেই চেতনা ও আদর্শকে অস্বীকার করা হচ্ছে এ ধরনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এখন সব পক্ষকেই বুঝতে হবে, যাতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায়।সমকাল: সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না হলে আপনারাও কি বর্জনের পথে হাঁটতে পারেন?জিএম কাদের: নির্বাচন বা সংসদ বর্জন করে ঠিক কী অর্জন করা যাবে– এটি এখনও আমি জানি না। সে জন্য আমরা এখনও সংসদ বর্জন না করে সংসদে আছি। আশা করছি, সামনের যে নির্বাচন, তা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। নির্বাচন থেকে সরে থাকলেই যে এটি বাস্তবায়ন হবে– এ ব্যাপারে আমরা এখনও নিশ্চিত নই। তবে এ কাঠামোতে যে নির্বাচন হবে না– তা আমরা বলে আসছি। বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। নির্বাচন বর্জন করব কিনা– এখনও আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি। পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেব।সমকাল: সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের আদালত নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে একটি রায় দিয়েছেন। যেটাকে যুগান্তকারী রায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশটির আদালত বলেছেন, ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও দুই নির্বাচন কমিশনারের নিযুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অংশ নেবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও লোকসভার বিরোধী দলের নেতা। আমাদের দেশেও যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমরা সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি উপায় খুঁজে নিতে পারি কিনা?জি এম কাদের: আমাদের দেশে বিদ্যমান ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি কোনো কিছু করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে করবেন– বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছাই চূড়ান্ত। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের কাউকে যুক্ত করা বা এমন কিছু– ভারতের আদালতের মাধ্যমে যেটা হয়েছে, সেটা আমরা করতে পারি। আবার যেটা সবচেয়ে বেশি আমাদের এখানে দেখা যায়; প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আচরণ সংবিধান অনুযায়ী না থাকা। সংবিধানে লেখা আছে– প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কাজ করবেন নাগরিকের জন্য। তাঁরা নিয়োজিত হবেন রাষ্ট্র বা প্রজাতন্ত্রের কর্মী হিসেবে। কিন্তু এখানে দেখা যায়, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা সরকারদলীয় হয়ে কাজ করেন। সেটা ন্যায় বা অন্যায় যা-ই হোক না কেন; প্রজাতন্ত্রের হওয়ার চেয়ে সরকারদলীয় হওয়ার দিকেই তাঁদের আগ্রহ বেশি থাকে। বর্তমানে এমন ব্যবস্থায় যাঁরা নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে পরিবেশ নিশ্চিত করার কাজে থাকার কথা, তাঁরা তা দলের স্বার্থে করছেন। আবার নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার বিষয়ও আছে। কমিশন যাঁদের নিয়ে কাজ করবে তাঁরা দলীয় হওয়ায় কমিশনের কাজ যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হয় না। আমরা শুনেছি, কমিশনের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ করা হয়, তা অনেকাংশেই মানা হয় না। ধরা যাক, কোনো এলাকার নির্বাচনের সময় সেখানকার জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপারকে বদলির সুপারিশ করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় কমিশনের হাতে এসব ক্ষমতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা নির্ভর করে নির্বাহী বিভাগের হাতেই। তাই ভারতের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা সেখানকার নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে বলে আশা করা যায়। একই পদ্ধতি আমাদের এখানে কাজ করবে না বলেই মনে হয়। কারণ, আমাদের এখানে সমস্যা আরও গভীরে। আমাদের এখানে আইন আরও কঠোর ও পরিবর্তন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।সমকাল: আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিলে কীভাবে নেবে? দলীয়ভাবে, নাকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে?জি এম কাদের: ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি; কারও সঙ্গে জোট করেনি। তার পরও জাতীয় পার্টি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন নিয়ে সংসদে ছিল। ২০০৮ সালে এসে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে মহাজোট করা হয়েছিল। মহাজোটের শর্ত মেনে আমরা যেখানে প্রার্থী দিয়েছিলাম; আওয়ামী লীগ সেখানে প্রার্থী দেয়নি। আবার আওয়ামী লীগ যেখানে প্রার্থী দিয়েছিল; সেখানে আমাদের পার্টি প্রার্থী দেয়নি। সে সময় আমরা কিন্তু ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করিনি। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না। আমরা তখন বিএনপির বিপক্ষে জোট করেছিলাম। যার ফলে নির্বাচনে গিয়েছিলাম। তার পরের দুই নির্বাচন– ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে আমি এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।সমকাল: তাহলে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কী করবে?জি এম কাদের: আমরা এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আগামী নির্বাচনে জোটবদ্ধ বা একক নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনও হয়নি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কীভাবে হবে; গতিপ্রকৃতি কোনদিকে যাচ্ছে; সেটি দেখার পরই সিদ্ধান্ত নেব। জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল। আমাদের পার্টির নিজস্ব কিছু রাজনীতি রয়েছে। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থিতা নিয়েই কাজ করছি। সেটা পারব কি পারব না– এখনই বলা সম্ভব না। পরিস্থিতি দেখে বলতে হবে। সে সময় আমরা দেখব কার সঙ্গে জোটে যাব; কার সঙ্গে যাব না।সমকাল: আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি বিশেষ কোনো চাপ রয়েছে বলে মনে করেন কিনা? যেহেতু দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার একটি আইনি জটিলতা আপনাকে পোহাতে হয়েছে।জি এম কাদের: চাপ তো সব সময়ই থাকে। রাজনীতিতে এটা আছে। তবে এখন দেশের রাজনীতি যেভাবে চলছে, তার ভবিষ্যৎ খুব মঙ্গলজনক কিছু হবে বলে আশা করা যায় না। রাজনীতিতে এখন অনিশ্চয়তা অনেক বেশি। আমাদের দেশের রাজনীতি অন্যান্য দেশের রাজনীতির মতো স্বাভাবিক গতিতে চলে না। আমাদের দেশে এখন অর্থনৈতিক একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আমার মনে হয়, অর্থনৈতিক এ অনিশ্চয়তা রাজনীতিকেও অনিশ্চিত পথে পরিচালিত করতে পারে।সমকাল: জাতীয় পার্টির প্রধান হিসেবে দেশবাসীর প্রতি আপনার বিশেষ কোনো বার্তা আছে?জি এম কাদের: দেশবাসীর কাছে আমি এটাই বলতে চাই– জাতীয় পার্টি একটা সময়ে দেশের ক্ষমতায় ছিল। তারা জাতীয় পার্টির রাজনীতি দেখেছে। যে প্রক্রিয়াতেই জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসুক না কেন; দেশবাসী কিন্তু তখন এর বিরোধিতা করেনি। এখনকার যে সরকারি দল, তারাও তখন স্বাগত জানিয়েছিল। দেশবাসীর মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল। এখন ৩২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও জাতীয় পার্টি টিকে আছে। দেশবাসীর মধ্যেও অনেকে জাতীয় পার্টিকে চায়। আমরাও তাদের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই– দেশবাসী এখন যেটা চায়, একটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সুশাসন; সেটা আমরা যদি সুযোগ পাই তাহলে নিশ্চিত করতে চেষ্টা করব।সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।জি এম কাদের: সমকালকেও ধন্যবাদ।#GMQuader