জি এম কাদের

৩ মে ২০২৪, শুক্রবার | মানবজমিন

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। কিন্তু, কিছু কিছু ক্ষমতাসীন শাসককে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো প্রেক্ষাপট ছাড়াই) এমন কথা বারবার বলতে শোনা যায়। লক্ষণীয় বিষয় হলো- এটা দেখা গেছে যে তারা নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই এমনটি করে থাকেন এবং সেই উদ্দেশ্য অনুসারে বাস্তবতাকে বিকৃত করার প্রবণতাও থাকে।

তারা চায়, জনগণ এটা মেনে নেবে যে, ক্ষমতাসীন সরকারের ধারাবাহিকতা স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। এভাবে তারা যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় থাকার ন্যায্যতা দেয়। তাদের যুক্তি: এতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে, উন্নয়ন হবে এবং শেষ বিচারে মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। আর এইভাবে, উপরে উল্লিখিত বিবৃতিকে বিদ্যমান সরকারের ধারাবাহিকতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়, এমনকি সেটা অন্যায্য উপায় ব্যবহার করে হলেও।

একটি সমাজের লোকজন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং ওই ব্যবস্থা পরিচালনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘সুশাসন’ পেতে চায়। সর্বোপরি, সুশাসন মানে হলো- আইনের শাসন এবং প্রাকৃতিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক সমাজ। ‘আইনের শাসন’ এর দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে: আইন (জাতি, ধর্ম, সামাজিক মর্যাদা, ইত্যাদি নির্বিশেষে) সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে; এবং ভাল ও খারাপ কাজের জন্য পুরস্কার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কোনো সমাজ সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে- এর মানে হলো সেই সমাজের মানুষের মধ্যে কোনো বঞ্চনা, বৈষম্য, দমনপীড়ন ইত্যাদি থাকবে না এবং নাগরিকদের সামাজিক ন্যায়বিচারকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।

আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর স্থিতিশীলতার মূল নিহিত। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য নিরবিচ্ছিন্ন পরিবেশকে স্থিতিশীলতা বলা যেতে পারে।

দেখা গেছে যে, সুশাসন রয়েছে এমন দেশই উক্ত স্থিতিশীলতা প্রদান করে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় এবং ইচ্ছা রয়েছে- সরকারে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কোনো সরকারের মধ্যে প্রয়োজনীয় এই রাজনৈতিক ইচ্ছা তখনই তৈরি হয় যখন তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। সেই জবাবদিহিতা কেবল গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেই অর্জন করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন ভালো একটি নির্বাচন যাকে গণতন্ত্র চর্চার প্রবেশদ্বার বলে বিবেচনা করা হয়। সঠিকভাবে নির্বাচিত সরকার নিজেদের কর্মকাণ্ডে জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করতে বাধ্য হয়, অন্যথায় তাদের ক্ষমতার বাইরে থাকার ঝুঁকি থাকে। এই চাপ শেষ পর্যন্ত তাদের সুশাসনের দিকে নিয়ে যায়।

যে সরকার যে কোনো উপায়ে (এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহিতা এড়িয়ে হলেও) ক্ষমতায় টিকে থাকতে পছন্দ করে, সে সরকার সুশাসন দিতে চাইবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। এর বিপরীতে, এ ধরনের সরকার সাধারণত রাষ্ট্রের সামগ্রিক জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাকে দুর্বল করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং দুর্নীতি চর্চায় লিপ্ত হয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ চরিতার্থ করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রোনিজম (বন্ধু, বিশ্বস্ত সহকর্মী, নিকটজনদের প্রতি পক্ষপাত) প্রতিষ্ঠা করে।

যখন সরকার যথাযথ জবাবদিহিতা ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকে, তখন তার নেতৃত্ব কর্তৃত্ববাদী হতে সমস্ত কর্তৃপক্ষকে কেন্দ্রীভূত করতে চায়। সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ নিজ নিজ স্বাধীন কর্তৃত্ব হারায় এবং সরকার প্রধানের অধীনস্থ হয়। সমগ্র শাসন ব্যবস্থা একটি মাত্র কেন্দ্রীয় বিন্দু অর্থাৎ সরকার প্রধানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি অনেকগুলোর পরিবর্তে একটি মাত্র স্তম্ভ দ্বারা নির্মিত দালানের অনুরূপ। কোনো কারণে ওই স্তম্ভটি কাত হলে, গোটা দালান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি কোনো কারণে স্তম্ভটি ভেঙে পড়ে, তবে দালানটি যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন, সেটি ভেঙে পড়ে। এভাবে এই ধরনের সরকার কেবল অস্থিতিশীল এবং দুর্বলই হয় না, পরিবর্তনের মারাত্মক আর সহিংস পরিণতির জন্যও সংবেদনশীল হয়ে উঠে।

একই সরকারের ধারাবাহিকতা অপরিহার্যভাবে রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে না। অনুপযুক্ত উপায়ে নিশ্চিত করা স্থিতিশীলতাকে বড়জোর কৃত্রিম এবং/অথবা ঠুনকো বলা যেতে পারে। ক্ষমতার পরিবর্তনে এ ধরনের স্থিতিশীলতা বড় এবং/অথবা সহিংস ব্যাঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

একটি দেশের স্থিতিশীলতার পরীক্ষা হল- সরকার বা নেতৃত্বের যেকোনো ধরনের পরিবর্তনে দেশটি কতোটা সংবেদনহীন থাকতে পারে। যখন কোনো দেশে এমন লক্ষণ দেখা যায় যে এটি সরকার পরিবর্তন হলেও সব ক্ষেত্রে স্থিতিশীল থাকবে, তখনই “স্থিতিশীল” শব্দটি সেই দেশের প্রাপ্য হওয়া উচিত।

কখনও কখনও সরকারি ব্যবস্থা এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে দীর্ঘ সময়ের জন্য একই ব্যক্তি সরকার প্রধান হিসেবে না থাকতে পারেন। কোনো সর্বোচ্চ নেতাকেই নির্দিষ্ট সময়সীমার বাইরে চালাতে দেওয়া হয় না। স্বৈরাচারী শাসক হওয়ার জন্য সরকার প্রধানকে খুব বেশি সময় না দিতেই এমনটি করা হয়। ইতিহাস বলে, সবসময় তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

“কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন” এই বক্তব্যে ফিরে আসলে দেখা যায় যে কেবল “স্থিতিশীলতা” শব্দটি-ই নয়, “উন্নয়ন” শব্দটিরও ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উন্নয়নকে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন-ই বলা হয়। এটিও একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করা হয়: সরকারি নেতৃত্বের কর্মক্ষমতাকে মহিমান্বিত করতে এবং শেষ পর্যন্ত (এমনকি অনুচিত উপায়ে হলেও) ক্ষমতায় থাকার ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য। উপরন্তু, তারা সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা আদায় করতে এভাবে “উন্নয়ন” শব্দটি ব্যবহার করে।

কিন্তু, অবকাঠামোগত উন্নয়ন সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি অংশ বা উন্নয়নকে সাহায্য করার একটি উপায় মাত্র। উন্নয়ন বলতে একটি দেশের গড় নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার উন্নতিকে বোঝায়।

কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য সাধারণত অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু, তা যদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের জীবনযাত্রায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন না আনতে পারে, তাহলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কোনোভাবেই উন্নয়নের সহায়ক নয়; অবকাঠামোর উন্নয়নকে উন্নয়নের অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা উচিত নয়। কখনও কখনও, অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর্থিক বোঝা হয়ে উঠতে পারে এবং প্রকৃত উন্নয়নের বিপরীত হতে পারে।

উন্নয়নের নামে অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রায়শই সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি কোষাগার থেকে কিংবা স্থানীয় এবং/অথবা বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। এগুলো বাস্তবায়নের সময় অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে বাজেট ছাড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত, অবকাঠামোর ব্যয় তা থেকে প্রাপ্ত সুবিধাকে ছাড়িয়ে যায়। নিজেদের জীবনযাত্রার মানের অসামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নতি কিংবা উন্নতি না হলেও সাধারণ নাগরিকরা ঋণের ভারী বোঝা নিয়ে পড়ে আছে।

কোনো সরকার বা ব্যক্তি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয় না। এর পরিবর্তে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ঝুঁকি তৈরি হয়। অবকাঠামোর উন্নয়ন সবসময় প্রকৃত উন্নয়নের নিশ্চয়তা প্রদান করে না। প্রকৃত অর্থে দেশের উন্নয়ন হলো: দেশের সাধারণ নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন।

[লেখক: জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এবং সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা]