bd-pradin

ঢাকা, মঙ্গলবার.
প্রকাশ : ২৭ মে, ২০১৪ ০০:০০:০০আপডেট : ২৭ মে, ২০১৪ ০০:৫১:৪১
জি এম কাদের

জাতীয় পার্টির বর্তমান কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে পার্টিতে সমন্বয় সাধন। যারা পার্টির চেয়ারম্যানের নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেছেন, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী হয়েছেন তাদের পার্টির মূল ধারার (যারা নির্দেশ পালন করে নির্বাচন বর্জন করেছেন) সঙ্গে পুনঃসংযোজিত করার জন্য সমঝোতার মাধ্যমে একত্রিত করা। আশা করা হচ্ছে একতাবদ্ধ হলে পার্টি সংগঠিত ও সুসংহত হবে। বর্তমানে দেশে সংসদের বাইরে অবস্থান গ্রহণকারী বিরোধী দল যারা সরকারের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত এবং বর্তমান সরকারের ভালোমন্দ সব কিছুরই বিরোধিতা করে আসছে, তারা সরকারের নিষ্পেষণে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ফলে এ ধারা বজায় থাকলে একপর্যায়ে ওই বিরোধী দল কার্যকারিতা হারাতে পারে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সরকারবিরোধী জনসমষ্টি তখন জাতীয় পার্টিকে বিকল্প হিসেবে গণ্য করতে উৎসাহিত হতে পারে। সে প্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন বৃদ্ধি পেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনঃআত্দপ্রকাশের সুযোগ আসবে।
এ দুটি আশার সঙ্গে অবশ্য দুটি আশঙ্কাও থাকে। নির্দেশ অমান্যকারী বা শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের মেনে নিয়ে ভবিষ্যতে দলীয় নির্দেশ পালনের আবশ্যকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে কিনা? সে ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা? সুশৃঙ্খল না হলে কোনো সংগঠনই সুসংহত ও শক্তিশালী হতে পারে না।
দ্বিতীয় আশঙ্কা সরকার সমর্থিত বিরোধী দল বা যারা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দল হিসেবে গণ্য ও সরকারি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে তারা ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী জনসমষ্টির আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে কিনা? বাস্তবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, জাতীয় পার্টির সমর্থক ভোটারদের বড় অংশ উল্টা পথে হাঁটছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নেতা-কর্মীদের অনেকেই জাতীয় পার্টি ত্যাগের মানসে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।
সংসদে বিরোধী দল হিসেবে শুধু নামকরণ করলেই সংসদে কোনো দল বিরোধী দল হয় না। কোনো ব্যক্তিকে রাজা নাম দিলে বা রাজার পোশাক পরালে বা ঘটা করে সারা শরীরে রাজা নাম লিখে দিলেও সে কখনো রাজা হয় না। রাজা হওয়ার জন্য তার একটি রাজ্য প্রয়োজন হয় এবং সে রাজ্য পরিচালনার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা থাকতে হয়। সে ক্ষেত্রে তার নাম যাই হোক, পোশাক-পরিচ্ছদ যাই হোক তা বিবেচ্য বিষয় হয় না। বর্তমান সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং আনুষঙ্গিক পদে অধিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির নির্বাচিত প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের আনুকূল্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মনোনয়ন প্রত্যাহারের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। একই প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির বেশির ভাগ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। সংসদ সদস্য যারা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে প্রায় ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাতীয় পার্টির প্রার্থীর অনুকূলে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে ও তাদের নেতা-কর্মীরা সে প্রার্থীর জন্য কাজ করেছে। ফলে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট বলা হয়তো অত্যুক্তি হয় না। বাস্তবতার নিরিখে ধারণা করা যায়, জাতীয় পার্টির সংসদীয় দল জনগণের পক্ষ থেকে নয় বরং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সরকারের বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য ম্যান্ডেট লাভ করেছে। সংসদে জাতীয় পার্টির জন্য বিরোধীদলীয় ভূমিকা পালন বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবিধান অনুযায়ী অবাস্তব। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫ (৩) ধারা অনুযায়ী ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন’। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা কেউ দ্বিমত পোষণ করলেও বা কোনো সংশোধনী প্রস্তাব করলেও মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন হওয়ার পর সংসদে তা উত্থাপিত হওয়ার বা পাস হওয়ার সময় সব মন্ত্রীর সম্মতি আছে বলে গণ্য হবে। সংবিধানের ৭০ ধারা অনুযায়ী যদি কোনো সংসদ সদস্য সংসদে কোনো নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ওই দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোটদান করেন তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে। এমনকি যদি কোনো সংসদ সদস্য সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকেন বা সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন তিনি বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং তার সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।
সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা বাস্তবে সরকার কর্তৃক উত্থাপিত কোনো বিল বা সিদ্ধান্ত প্রস্তাবে ভুলত্রুটি এবং গণস্বার্থবিরোধী ভূমিকা চিহ্নিত করা ও তা সংসদে তুলে ধরা। যদি সরকার যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত বিরোধী দল কর্তৃক উত্থাপিত সংশোধনী বা দাবিগুলো অগ্রাহ্য করেন তবে ‘না ভোটের’ মাধ্যমে বা ওয়াকআউট করে তারা সরকারের প্রস্তাবিত কার্যকলাপের প্রতিবাদ জানাবেন। বিরোধী দল হিসেবে সংসদীয় দলের সিদ্ধান্ত তাই থাকে। বর্তমান মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যের বেশ কয়েকজন অন্তর্ভুক্ত। ফলে সংসদে জাতীয় পার্টি ওই ধরনের বিরোধীদলীয় ভূমিকা পালন করার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পার্টির মন্ত্রিসভার সদস্যরা সংবিধানের উপরোক্ত দুটি বিধানের কারণে তাদের সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। অবশ্য তারা টেকনোক্রেট কোঠায় মন্ত্রী থাকতে পারেন, সংসদ সদস্য হিসেবে নয়। সে ক্ষেত্রে তাদের পরিচয় জাতীয় পার্টির সদস্য হিসেবে প্রাধান্য পাবে না। সে কারণে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের সঙ্গে সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হওয়া সাংবিধানিকভাবে সাংঘর্ষিক ও অবাস্তব গণ্য করা যায়।
জনসমর্থন এবং সাংগঠনিক দিক বিবেচনা করলেও জাতীয় পার্টি বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হওয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতাবান নয়।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান যিনি শুধু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানই নন, তাকে পার্টির প্রাণপুরুষ বলা যায়। পার্টির ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা অনেকাংশে তার ব্যক্তিত্বের ও কার্যকলাপের ওপর নির্ভরশীল। পার্টি চেয়ারম্যানের ভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়, যে কোনো প্রক্রিয়ায় তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে আনা হয়েছে। কিন্তু তিনি সংসদে সদস্য হিসেবে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তাকে সংসদীয় দলের নেতা বা বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়নি। জাতীয় পার্টির ইতিহাসে অতীতে কখনোই তিনি সংসদে সদস্য থাকাকালীন অন্য কেউ সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হননি। যদিও প্রচার করা হয়েছে তিনি স্বইচ্ছায় ওই পদসমূহ গ্রহণ করেননি। এ তথ্যটি সঠিক নয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আগে কোনো সময়ে তেমন মতামত দিলেও পরবর্তীতে যথাসময়ে তিনি সংসদীয় দলের নেতা ও বিরোধী দলের নেতা হওয়ায় তার অনাপত্তি জানিয়েছিলেন। ফলে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা যাদের ভোটে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন তারা যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের নিয়ন্ত্রণে আছেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ আছে। এখানে উল্লেখ্য, জাতীয় পার্টি থেকে যেসব সংসদ সদস্যকে মন্ত্রিপরিষদে নেওয়া হয়েছে তাদের মনোনয়ন দলীয় চেয়ারম্যান দেননি এবং তার কোনো মতামত বা সম্মতি নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। ফলে যে যাই বলুক সংসদে জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ পার্টি চেয়ারম্যানের এবং সে কারণে মূল দলের হাতে নেই, এটা ধরে নেওয়া যায়।
আগে যে আশঙ্কার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সে আশঙ্কা যদি সত্য হয় তবে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ ভালো দেখি না। ঙহব ঞরসব টংব চষধঃব এর মতো ব্যবহৃত হয়ে রাজনৈতিক আবর্জনার স্তূপে জমা হবে। স্বকীয়তাবিহীন নামসর্বস্ব দল হিসেবে ভবিষ্যতে বৃহৎ কোনো রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনে সে মূল্যায়নেই ব্যবহৃত হতে পারে, এর বেশি কিছু নয়।
আশঙ্কা যাতে সত্যে পরিণত না হতে পারে সে জন্য আশঙ্কার কারণগুলো বিশেষ করে মেকি বিরোধী দল, সুবিধাবাদীদের দল_ এ ধরনের ভাবমূর্তি জরুরি ভিত্তিতে দূর করা আবশ্যক। সে উদ্দেশ্যে বাস্তবসম্মত সমাধানের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
দেশের বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক রাজনীতি বলা যায় না। প্রজাতন্ত্র অর্থ সেই দেশ যে দেশের সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণ। সে দেশে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত একটি সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত আরেকটি দল থাকবে যারা বিরোধী দল হিসেবে আখ্যায়িত হবেন। তাদের কাজ হবে সরকারের ভুলত্রুটি এবং গণস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম সঠিকভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরা ও চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে শাসককার্যে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে ও সে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকার ও বিরোধী দল উভয়কে মূল্যায়ন করবে এবং তাদের যথাযথ স্থানে বহাল করবে। এই হলো প্রজাতন্ত্রের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ রাজনীতি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে শাসক আছে, শাসন আছে কিন্তু শাসনকার্যের জবাবদিহিতা নেওয়ার মতো কোনো বিরোধী দল বাস্তবে নেই। রাজতন্ত্রের জন্য যেখানে দেশের মালিক কোনো ব্যক্তি বা পরিবার সে ক্ষেত্রে এ রাজনীতির পদ্ধতি চলতে পারে, প্রজাতন্ত্রের জন্য যেখানে দেশের মালিক জনগণ, সেখানে এ রাজনীতি ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ।
এ ধরনের রাজনীতি দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সীমাবদ্ধ সম্পদ বিশাল জনসমষ্টির দেশে রাজতন্ত্র বা যে কোনো ধরনের জবাবদিহিতাবিহীন একনায়কত্ব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে না। শাসকের বিরুদ্ধে বিরাট জনসমষ্টির ক্ষোভ ও অসন্তোষ সহজেই দানা বাধার সুযোগ থাকে। অস্থিরতা প্রশমন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে শক্তি প্রয়োগে জনগণের এ অসন্তোষ বেশি দিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না। ফলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত ও উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে বিনিয়োগে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাপকভাবে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি স্বাভাবিকভাবে ঘটতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে চরমপন্থি ও মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান সহজতর হয়। এ থেকে উদ্ধারের জন্য অসন্তোষ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ও প্রয়োজনে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। এ আকাঙ্ক্ষা পূরণে শাসনব্যবস্থায় দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দল থাকা আবশ্যক।
লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় পার্টি।