বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রকোপে অর্থনীতি স্থবির ও মন্দাকবলিত। বাংলাদেশে এর প্রভাব সুস্পষ্ট। চাহিদা, সরবরাহ ও উৎপাদন- সবকিছুই নিম্নমুখী। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে, কর্মজীবীরা কর্মচ্যুত হচ্ছে, বেকার সংখ্যা বাড়ছে আর বাড়ছে দারিদ্র্য ও অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা। এ মুহূর্তে মানুষের জীবন রক্ষা আর জীবিকার সংস্থান সৃষ্টি সময়ের দাবি।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ কোটি টাকার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ছিল, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ৩ লাখ ৯১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার চেয়ে ১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
অর্থাৎ এক কথায়- ২০২০-২১ সালের বাজেট সার্বিকভাবে ২০১৯-২০ সালের বাজেটের ধাঁচে রাখা হয়েছে। শুধু পার্থক্য, বিগত কয়েকটি বছর বাজেটে প্রায় সব খাতেই বরাদ্দ বৃদ্ধির উচ্চহারের যে ধারাবাহিকতা ছিল, এবার তা বজায় রাখা হয়নি। একই ধরনের ধারা রাজস্ব আয়, উন্নয়ন বাজেট বা পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা রায়।
খাতওয়ারি বরাদ্দগুলোর বিষয়ে গতানুগতিক ধারা বজায় রাখা হয়েছে। বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দৃষ্টিগোচর হয় না। একটু পার্থক্য যা চোখে পড়ে তা হল, কিছু অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেসব ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ বৃদ্ধি ও কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বরাদ্দের সঙ্গে থোক বরাদ্দ দিয়ে করোনাভাইরাসজনিত সমস্যা মোকাবেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে যেখানে করোনাভাইরাসের কারণে বিগত তিন মাসের অধিক সময় প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ ছুটির আওতায় অনুৎপাদনশীল ছিল, সেখানে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যে সম্ভব হয়নি; তা বোঝা যায়।
কেননা এ সময়টায়ই সাধারণত এ বিষয়গুলো সম্পন্ন করা হয়। ফলে আনুমানিক বৃদ্ধি ও থোক বরাদ্দ রাখা ছাড়া সুস্পষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক খাতওয়ারি বরাদ্দ সম্ভব ছিল না বলা যায়। অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেছেন, যে কোনো ধরনের একটি বাজেট পাস করা জরুরি অর্থ খরচের জন্য। অর্থাৎ তিনি বুঝিয়েছেন, দরকারি যে পরিবর্তনগুলো পরে করা হবে তা সম্পূরক বাজেটের মাধ্যমে সমন্বয় করা যাবে। এ বিষয়টি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক বলা যায়। এতে দোষের কিছু দেখি না।
কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া থোক বরাদ্দ সাধারণত ‘অ্যাডহক বেসিসে যখন যেখানে দরকার, তখন সেখানে ব্যয় করা হবে’ ভিত্তিতে ব্যয়িত হয়। ফলে অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির কারণে জনকল্যাণে অর্থ ব্যবহৃত না হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে কারণে থোক বরাদ্দ ব্যবহারে যথার্থতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য এ সংক্রান্ত একটি মনিটরিং টিম বা সমন্বয় কমিটি গঠন করে তাদের ওপর যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দেয়া যেতে পারে।
বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে অধিকাংশ সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি পর্যুদস্ত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। পরিবর্তিত এ বাস্তবতাকে বিবেচনায় না এনে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা গত অর্থবছরের চেয়ে কিছু হলেও বেশি রাখা হয়েছে। ধারণা করা হয়, বাজেট কাঠামোকে ইতিবাচক রাখার জন্য এটা করা হয়েছে।
তবে বাস্তবতা হল, করোনাকালীন নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে নিশ্চিতভাবে এ বাজেট বাস্তবায়ন একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। বাজেটটি সংবিধান অনুযায়ী আয়-ব্যয়ের হিসাব হিসেবে উত্থাপিত হলেও বাস্তবে আয়ের স্বল্পতা, এমনকি সেটিতেও অনিশ্চয়তা এবং ব্যয়ের বিশালত্ব ও জরুরি আবশ্যকতার কারণে এটি একটি অসঙ্গতিপূর্ণ ও সমন্বয়হীন প্রতিবেদন হিসেবে দেখার সুযোগ আছে।
রাজস্ব ও অন্যান্য খাতে আয়ের সুযোগ কমেছে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তার বিপরীতে করোনা সংকট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ব্যয় বৃদ্ধি, জীবিকা হারানোর কারণে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, বেকার ও জীবিকা হারানো নব্য বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, কৃষি খাতকে চাঙ্গা রাখা ও কৃষকদের উৎপাদনে উৎসাহিত করা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক অর্থায়ন করতে হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থাকে ভার্চুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে চালু করতে ও ভবিষ্যতে এ পদ্ধতির ব্যাপক বিস্তার ও সক্রিয় রাখার বন্দোবস্ত করতে হবে। করোনা উত্তরকালেও ভার্চুয়াল প্রযুক্তির ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়বহুল ও সুবিধাজনক হবে। ফলে এ খাতেও অর্থায়ন দরকার।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বিশাল ঘাটতির বাজেট; ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার ঘাটতির চেয়ে এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৪৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকা বেশি।
তবে ঘাটতি জিডিপির শতকরা হার হিসাবে সব সময় ৫ থেকে ৫ দশমিক ৫ ভাগ ছিল। বাজেটে সেটা ৬ শতাংশ উন্নীত করা হয়েছে। ঘাটতি কমাতে হলে ব্যয় কমাতে হবে, আয় বাড়াতে হবে। পরিচালন ব্যয় কমানো কঠিন কাজ, তবুও যতটা সম্ভব কৃচ্ছ্রতাসাধনের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দের কিছু কাটছাঁট করে, করোনাকালীন সংকটগুলো মোকাবেলার বাড়তি অর্থায়নের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
উন্নয়ন ব্যয়ের অগ্রাধিকার নির্ণয়ের কাজটিও খুব সহজ নয়। মেগা প্রকল্পগুলোর সব চালু রাখা হবে কিনা, না হলে কোনটি রাখা হবে, কোনটি স্থগিত বা কোনটিতে সীমিত খরচ করা হবে- সেটি নির্ধারণ করা কঠিন হবে। কেননা প্রতিটি ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন কারণে, বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থার কারণে প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আয় হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে কারণে বাজেটে প্রাক্কলিত বড় ধরনের ঘাটতি, প্রকৃত প্রস্তাবে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
রফতানি আয় হ্রাস পাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত। তৈরি পোশাক খাতে আয়, যা রফতানি আয়ের সিংহভাগ, বিশ্ব মহামারীর ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ব্যাপক হ্রাস পেতে পারে। তাছাড়া বিশ্বজুড়ে পেট্রোলিয়াম তেলের চাহিদা কমেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে এর দাম কমে গেছে।
ফলে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো- যেখান থেকে আমাদের বেশির ভাগ প্রবাসী আয় আসে, সেখানকার অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রবাসী শ্রমিকরা সেখানে কর্মচ্যুত হচ্ছেন, যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে প্রবাসীদের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমার আশঙ্কা আছে।
শুল্ক আয় বৃদ্ধির বড় ধরনের পদক্ষেপ যাকে desperate move হিসেবে অনেকে দেখছেন, তা হল কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, এতে শুধু সুনাগরিকদের আইন ও নীতির প্রতি আনুগত্যকে নিরুৎসাহিত করা হবে না, এ সুযোগ দুর্নীতিকেও উৎসাহিত করবে। অতীতে বিভিন্ন সময় নানা শর্তে এ সুযোগ চালু ছিল, এখনও আছে। তবে এত ঢালাওভাবে শুধু কিছু অর্থের বিনিময়ে সব ধরনের অপকর্ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে বৈধতা দেয়ার শর্তহীন বিধান কখনও ছিল কিনা, সন্দেহ।
তাছাড়া আমাদের দেশে প্রায় সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা থাকে না। দেখা যায়, নতুন কোনো সরকার আগের সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাতিল বা এর সঙ্গে সুবিধাভোগীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। ফলে এ সুবিধা গ্রহণ কতটুকু নিরাপদ, তা নিয়ে কালো টাকার মালিকরা দ্বিধায় থাকে।
বাস্তবে এ খাতে সাধারণত খুব বেশি রাজস্ব আয় হয় না। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সব সময় এ সুযোগ দেয়া হলেও মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে, যার মধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।
এতে করে আর একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে কালো টাকার মালিকরা শাস্তির আওতায় আসবে- এ ধরনের পরিবেশ না থাকলে বা যদি ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ থাকে তবে সাদা করার তাগিদ থাকে না।
সম্ভব হলে এ বিধানটি বাতিল করা বাঞ্ছনীয়, সম্পূর্ণ সম্ভব না হলেও শর্তযুক্ত করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। যে আয়গুলো বৈধভাবে অর্জিত কিন্তু শুধু শুল্ক না দেয়ার কারণে কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত, সেগুলোর ক্ষেত্রে শুল্ক দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেয়া যায়। কোনো কোনো খাত যেখানে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, কালো টাকা সেখানেও সাদা করার সুযোগ দেয়া যায়।
আরেকভাবে রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ আসে তা হল, বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হল, এতে করে বাংলাদেশের বর্তমান ব্যাংকিং খাতের বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের তারল্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন মতো ব্যাংকের তহবিল না পাওয়া ও সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগে দরকারমতো খরচ করতে থাকব, আয় পরে যেভাবেই হোক করব। এ কথায় আশ্বস্ত হওয়া কঠিন। আয় করতে ব্যর্থ হলে নতুন টাকা ছাপিয়ে ব্যয় মেটাতে হবে, যার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি সরকারকে ঋণ নিতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে টাকা ছাপালে এতে করে মুদ্রাস্ফীতি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। ফলে সেদিকটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা যেগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে সেগুলোর ব্যবহার ত্বরান্বিত করা এবং নতুন ঋণ ও সহায়তা পাওয়ার প্রচেষ্টা নিতে হবে।
উপরিউক্ত পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সুপারিশ থাকবে সম্ভাব্য আয়ের পরিমাণ বুঝে তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যয় করা। সেক্ষেত্রে খরচের অগ্রাধিকার নির্দিষ্ট করতে হবে। অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সে ভিত্তিতে অর্থায়ন করতে হবে।
যে খাতগুলো জরুরি নয়, সেখানে অর্থ ছাড় দেয়া কমাতে হবে। সম্পূরক বাজেটের মাধ্যমে বিষয়গুলোকে পরে সমন্বয় করা যাবে। তবে Periodical Review-এর ব্যবস্থা করা যায়। ৬ মাস পর আয়-ব্যয়ের হিসাব ও বরাদ্দ পুনর্বণ্টনের খসড়া সংসদে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে এ মূহূর্তে যা প্রয়োজন তা হল, সার্বিকভাবে সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা বৃদ্ধি। সরকারি সব হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ক্লিনিক জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত আছে- সেগুলোয় মঞ্জুরিকৃত পদসমূহের যেখানে পদ খালি সেখানে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী ও অন্যান্য কর্মচারী জরুরিভাবে নিয়োগ দিতে হবে।
চিকিৎসা সহায়ক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের প্রয়োজন নিরূপণ ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক চিকিৎসাস্থলে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসাসেবার আলাদা ব্যবস্থা থাকতে হবে। কমপক্ষে জেলা পর্যায় পর্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে হবে।
আমাদের কৃষি খাত বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই এ খাতের অবদান নিশ্চিতভাবে আমাদের বড় ভরসার স্থল। করোনাকালীন ও করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রয়োজনে সারা বিশ্বের কারও কোনো সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে, যদি কৃষি খাত সচল থাকে।
কৃষি খাতকে সে কারণে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এ খাতের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকাণ্ডকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ, কৃষি সরঞ্জামাদি সহজলভ্য করতে হবে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও বিপণন, উৎপাদিত পণ্য যাতে নষ্ট না হয় ও কৃষকরা প্রকৃত দাম পায় তার বন্দোবস্ত করতে হবে। প্রকৃত কৃষকরা যাতে প্রণোদনার সুযোগ-সুবিধা সরাসরি পেতে পারে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
যতদিন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় ততদিন নিম্নবিত্ত, দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষদের চিহ্নিত করে প্রত্যেককে আলাদা ধরনের রেশন কার্ড বিতরণ করতে হবে। সে কার্ডের আওতায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে স্বল্পমূল্যে অথবা দরকার হলে বিনামূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নগদ অর্থ সাহায্য নির্দিষ্ট সময় পরপর সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি সুদহারে ঋণ সুবিধা সম্প্রসারিত করতে হবে। তাছাড়া কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ সৃষ্টি করে নব্য বেকার ও বিদেশফেরত প্রবাসীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি।
পোশাক শিল্পের বাইরে অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতকেও উৎসাহিত করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবহার উপযোগী করার বন্দোবস্ত নিতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কার্যকরভাবে One Stop Service ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজন নিরূপণ করে সে অনুযায়ী আবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ-স্কুল, এমনকি প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত ভার্চুয়াল শিক্ষাদান পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে চালু করা দরকার। দেশে করোনার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার পরও স্বাভাবিক পরিবেশে ভার্চুয়াল শিক্ষা চালু রাখলে সব পক্ষই লাভবান হবে। সে লক্ষ্যে অর্থায়ন করা দরকার।
বাজেট বাস্তবায়নে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে, যার কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘সুশাসন’। বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সব কার্যক্রমের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি সব স্তরে ‘জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতাকে’ প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা।
উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সুস্পষ্ট দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে এবং পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও সে অনুযায়ী মূল্যায়ন ও পদক্ষেপ নিতে হবে। আশা করি, সামনের দিনগুলোয় আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে করোনাভাইরাস মহামারীজনিত সংকট ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অর্থনৈতিক বৈরিতা উত্তরণে সফল হব।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের : এমপি ও চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি