গোলাম মোহাম্মদ কাদের
বাংলাদেশের সংবিধানে বর্তমানে শুরু, প্রস্তাবনা, এগারটি ভাগ ও সাতটি তফসিল আছে। সমগ্র সংবিধানটি ক্রমিক নম্বর ১ থেকে ১৫৩ পর্যন্ত অনুচ্ছেদসমূহ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ছাড়া কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু কিছু নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে। যেগুলো প্রাসঙ্গিক ক্রমিকের সঙ্গে বর্ণ যুক্ত করে দেখানো হয়েছে।প্রস্তাবনা অংশের দ্বিতীয় প্যারায় সংবিধানের মূলনীতি কী হবে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে আত্মোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;”অনুচ্ছেদ ১০৯, ‘আদালতসমূহের উপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ’সংক্রান্ত। এখানে বলা হয়েছে, “হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকিবে।” (ষষ্ঠ ভাগ, বিচার বিভাগ, প্রথম পরিচ্ছেদ-সুপ্রিম কোর্ট)।অনুচ্ছেদ ১১৬ “অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলা” বিষয়ে। বলা হয়েছে, “বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।” (ষষ্ঠ ভাগ, বিচার বিভাগ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ-অধস্তন আদালত)।একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেই বোঝা যায় অনুচ্ছেদ ১১৬ এবং ১০৯ অনুচ্ছেদসমূহের বিধানগুলো পরস্পরবিরোধী। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অনুচ্ছেদ ১০৯-এ “অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালসমূহের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা” দেওয়া হয়েছে হাই কোর্ট বিভাগের ওপর। একই সঙ্গে অনুচ্ছেদ ১১৬ অনুযায়ী সে বিভাগে কর্মরত সব ধরনের ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ, যেমন কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুর এসব ক্ষমতা সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালসমূহের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব একই সঙ্গে দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান হাই কোর্ট ও রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এখতিয়ারের মালিক এককভাবে রাষ্ট্রপতিকে করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালসমূহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছাড়া তত্ত্বাবধান কার্যকর হয় না। ফলে অনুচ্ছেদ ১০৯ অনুযায়ী অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাই কোর্ট বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলা যায়। সে কারণে সব ধরনের অধস্তন আদালতের কার্যকর ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত বলা যায়। এখানে উল্লেখ্য, নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করবেন এ বিধান রাখা হয়েছে। তবে তাদের পরামর্শ গ্রহণের বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় অধস্তন আদালতের কাছে উচ্চ আদালত ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার!’- এ ধরনের অকর্মণ্য গণ্য হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)-এ বলা হয়েছে, “এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন;” (চতুর্থ ভাগ, নির্বাহী বিভাগ, প্রথম পরিচ্ছেদ-রাষ্ট্রপতি)।উপরোক্ত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ফলে রাষ্ট্রপতি অধস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতেই করতে হবে। এক কথায়, দায়িত্বটি কার্যত প্রধানমন্ত্রীর অধীনই পালিত হবে, এটাই বাস্তবতা।অনুচ্ছেদ ৫৫(২)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে”। (চতুর্থ ভাগ, নির্বাহী বিভাগ, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ-প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা)। এর অর্থ প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের প্রধান। ফলে অধস্তন আদালতসমূহকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যকর নিয়ন্ত্রণে আনাকে এক কথায় নির্বাহী বিভাগের অধীনে ন্যস্ত করা বোঝায়, যা সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের ফল।উপরোক্ত বিষয়টি সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির একটি, অনুচ্ছেদ ২২, ‘নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ’-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখানে বলা হয়েছে “রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন” (দ্বিতীয় ভাগ, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি)।এ দেশের সংবিধান, সত্যিকার অর্থে একটি দীর্ঘমেয়াদি মুক্তিসংগ্রামের ফসল। মুক্তির আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নেয় স্বাধীনতাযুদ্ধে ও শেষ পর্যন্ত স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর অভ্যুদয় ঘটে। এ সুদীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধে এ দেশের অগণিত মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশায় পড়েছে, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে, জীবন দিয়েছে, তথাপি লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে।সংবিধান দেশটির সার্বিক পরিচালনার আইনগত দিকনির্দেশনার কাঠামো। ফলে দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন সংবিধানে থাকবে এটা অবশ্যই জরুরি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সময় সময় সংবিধান পরিবর্তন/পরিবর্ধন প্রয়োজন হতে পারে। তবে তাও হতে হবে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ও নাগরিকদের চেতনা ধারণ করে। কিন্তু যদি সংবিধানের বিধিবিধানসমূহের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা বা স্ববিরোধিতা থাকে সে ক্ষেত্রে জাতি বিভ্রান্ত হওয়ার ও বিপথে পরিচালিত হওয়ার ভয় থাকে। ফলে এ ধরনের আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকার স্বার্থে, সংবিধানে কোনো ধরনের অসামঞ্জস্যতা বা স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা গেলে জনগণের ইচ্ছা মোতাবেক প্রয়োজনে সংশোধন করা বাঞ্ছনীয়।লেখক : চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।