বিদ্যুৎ খাতে শ্বেতহস্তী সৃষ্টি ও প্রতিপালন কার স্বার্থে
প্রকাশিতঃ প্রথম আলো, 29/05/2024, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ
২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট মোকাবিলার উদ্দেশ্যে দুই বছরের জন্য ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে ২ বছর, ২০১৪ সালে ৪ বছর, ২০১৮ সালে ৩ বছর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ৫ বছরের জন্য এভাবে আইনের মেয়াদ চার দফা বৃদ্ধি করে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইনটি বলবৎ করা হয়।
এ আইনে এমন বিধান করা হয়েছে যে বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি আমদানি অথবা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অথবা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্য কোনো কার্যক্রম, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উপস্থাপন করা যাবে না। এ আইনের আওতায় বিনা দরপত্রে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয়, এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি, বিনা দরপত্রে গ্যাস-বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ, অবকাঠামো নির্মাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ আইন অনুসারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংক্রান্ত কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে না। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে এ আইনকে ‘দায়মুক্তি আইন’ বলে অভিহিত করা যায়। এককথায়, এ আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যুক্তিসংগত খরচে দেশব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু দায়মুক্তি আইন করে কর্তৃপক্ষকে অসীম ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
এখন ২০২৪ সাল। লোডশেডিং অব্যাহত আছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াটের ওপর উৎপাদনসক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকার পরও লোডশেডিং করে ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত দেশে ১৫১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। এগুলোর মধ্যে ৪২টি সরকারি এবং ২৬টি বেসরকারি অর্থাৎ মোট ৬৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র গত ৫ অর্থবছরে তাদের উৎপাদনসক্ষমতার ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। কিন্তু উৎপাদন না করেও উৎপাদনের পূর্ণ ক্ষমতার জন্য তারা সরকারের কাছ থেকে ভাড়া হিসেবে ক্যাপাসিটি চার্জ গ্রহণ করেছে।
বলা হয়, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) প্রতিবছর উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করার কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে জনগণের অর্থে গঠিত সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়। বাজেট অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সে সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ বা ব্যবহার না করে প্রদেয় ভাড়া হিসেবে আনুমানিক ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রদান করা হয়েছে। এটা মোট ভর্তুকির ৮১ শতাংশ। এককথায়, পিডিবির ক্ষতি কমানোর জন্য যে ভর্তুকির অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার ৮১ শতাংশ খরচ হয় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া বাবদ অর্থ প্রদানে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, পিডিবির লোকসানের অধিকাংশই বেসরকারি ভাড়া করা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ খাতে তাদের চুক্তি অনুযায়ী মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদানের কারণে।
গ্যাসচালিত বড় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্প্রতি উৎপাদনে গেছে। এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ১ হাজার ১৬৭ মেগাওয়াট। একই এলাকায় ৭১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যুক্ত হওয়ার পর বিপিডিবির মোট উৎপাদনসক্ষমতা আরও বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা না থাকায় ব্যবহার না করে ভাড়া হিসেবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। অর্থাৎ মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ব্যয় আরও বাড়বে।
এককথায় বলা যায়, চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও বা চাহিদার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ফলে এগুলোর অধিকাংশ উৎপাদন না করে বন্ধ থাকছে। উৎপাদন না থাকায় এসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয়ের সুযোগ নেই। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়ার জন্য বিপুল অর্থ প্রদান করতে হচ্ছে। সে কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতির প্রধান কারণ হলো ক্যাপাসিটি চার্জ।
জনগণের অর্থে ভর্তুকির প্রয়োজন হয়েছিল পিডিবির লোকসান কমানোর জন্য। বাস্তবে ক্ষতির প্রধান কারণ অলস বসিয়ে রাখা বেসরকারি ভাড়া করা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়ার অর্থ প্রদান। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের ঘাড়ে সরাসরি বোঝা চাপিয়ে ভর্তুকির অঙ্ক কমানো হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু বাড়তি দামের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থের অধিকাংশ ওই একই খাতে ভাড়া হিসেবে বেসরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রদান করা হচ্ছে।
অন্যভাবে বললে বলা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে এ থেকে আয় না হওয়া সত্ত্বেও যে ক্যাপাসিটি চার্জ বা তার খরচ দেওয়া হচ্ছে, সেটিই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র না থাকলে বা সংখ্যায় কম হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হতো না বা এত বেশি পর্যায়ে বৃদ্ধি দরকার হতো না।
২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩ দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী এ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। ফলে যুক্তিসংগত মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে, তা বলা যায় না। যেখানে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা বর্তমানে ১৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার মেগাওয়াট, সেখানে ২৭ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে সক্ষমতা তৈরি করা হলো কেন? আমাদের জানামতে সক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে এবং দেশি-বিদেশি ঋণ বাড়ছে। বিদেশি ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ নেওয়া হয় বিদ্যুৎ খাতের জন্য। বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে অর্থনীতির গতি যে বৃদ্ধি প্রয়োজন, সেটা লক্ষণীয় নয়। ফলে প্রশ্ন, কোন প্রাক্কলনের ভিত্তিতে ও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলো বা হচ্ছে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, বর্ধিত সক্ষমতা প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা হচ্ছে না বা করা যাচ্ছে না কেন? তাহলে এ অতিরিক্ত সক্ষমতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী ছিল?
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্যাপাসিটি চার্জ। এ চার্জসহ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া করা সমস্যা নয়। চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া প্রদান করা হলো মূল সমস্যা। কেননা, ব্যবহার না করলে এর থেকে কোনো আয়ের সুযোগ থাকে না। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে অর্থই প্রদান করা হয়, সেটি একতরফাভাবে ক্ষতির খাতকে সমৃদ্ধ করে। এককথায়, এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন শ্বেতহস্তী হয়ে বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ে বিশাল বোঝা হিসেবে অবস্থান করছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দেশীয় মালিকানাধীন। তাদের পাওনা বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করা হচ্ছে। এটার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না।
ব্যাংকিং আইনে কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি কোনো কোম্পানিকে ঋণ হিসেবে দিতে পারবে না। শুধু বিদ্যুৎ খাতে এই সীমা কার্যকর নয়; বিদ্যুৎ খাতে এ ধরনের সুযোগ ব্যাংক খাতের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাড়তি ঝুঁকির সৃষ্টি করার কথা।
বিদ্যুৎ খাতের কার্যক্রমে দায়মুক্তির মাধ্যমে ঢালাওভাবে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার পরও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হচ্ছে না। ন্যায্যমূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া তো দূরে থাক, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকে সুযোগ দিয়ে শ্বেতহস্তীসম বিদ্যুৎকেন্দ্র সৃষ্টি ও এগুলোর প্রতিপালনের খরচ হিসেবে ক্রমবর্ধমান উচ্চমূল্যের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
● গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি ও বিরোধীদলীয় নেতা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ