গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি
শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪ .। বাংলাদেশ প্রতিদিন
আমাদের দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা হলো ৩৮৮০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট পার ডে। পাঠকদের সুবিধার্থে এর পর থেকে মিলিয়ন ‘কিউবিক ফিট পার ডে’-এর পরিবর্তে ‘ইউনিট’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ করতে পারে ৩০৫৬ ইউনিট, এ হিসাবে দৈনিক ঘাটতি ৮২৪ ইউনিট।
ঘাটতির খাতওয়ারি হিসাব নিম্নরূপ- বিদ্যুৎ -৪৫২.৬৫ ইউনিট, শিল্প-১৯৭.৫২ ইউনিট, গৃহস্থালি-৮২.৩ ইউনিট, সার-৫৭.৬১ ইউনিট, সিএনজি-২৪.৬৯ ইউনিট, বাণিজ্যিক-৮.২৩ ইউনিট। অর্থাৎ প্রতিটি খাতেই প্রয়োজনের তুলনায় ২১.২১ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে।
আমদানিকৃত এলএনজি জাহাজ থেকে আমাদের গ্যাস সরবরাহ সিস্টেমে গ্রহণ করার জন্য যে ব্যবস্থা বিদ্যমান তা নিম্নরূপ- দুটি জাহাজ থেকে এলএনজি খালাস করা হয়। সেগুলোর প্রতিটিতে ক্যাপাসিটি ৫০০ ইউনিট। ফলে বেশি এলএনজি আমদানি করতে হলে ওই ধরনের জাহাজের সংখ্যা ও সুবিধা বাড়াতে হবে। তা ছাড়াও জাতীয় গ্রিডের পাইপলাইনের মুখে ১০০০ ইউনিট বেশি প্রবেশের সক্ষমতা তৈরি করা হয়নি। ফলে এখনই অতিরিক্ত এলএনজি আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এ সুবিধা তৈরি করা সময়সাপেক্ষ।
বর্তমান আমদানি খরচ ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত চার অর্থবছরের হিসাবে গড়ে প্রতি বছর ২১,৪১৬.৭৫ কোটি টাকা। বর্তমান ঘাটতি ৮২৪ ইউনিট। বাস্তবতা হলো- এ ঘাটতি যদি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয় সে ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানিতে বর্তমানে যে খরচ হয় তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ আমদানির জন্য ব্যয় করতে হবে। বর্তমানে আমদানি করা হয় ১০৪১ ইউনিট। বাস্তবতা হলো, বর্তমান সরকার আর্থিকভাবে এ ঘাটতি পূরণ করতে পারছে না। তাছাড়া বর্তমানে যতটুকু এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, তার অতিরিক্ত এলএনজি আমদানি করলেও এ মুহূর্তে তা খালাস ও জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ সুবিধাদি সৃষ্টি না করায় কারিগরিভাবে তা সম্ভব নয়।
বর্তমানে জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস জাতীয় সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ আসে দুটি উৎস থেকে। প্রথমত, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন ও সরবরাহ- যার পরিমাণ হলো ২০১৫ ইউনিট। দ্বিতীয়টি হলো আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি ক্রয়ের মাধ্যমে সরবরাহ। যার পরিমাণ ১০৪১ ইউনিট। অর্থাৎ বর্তমানে দেশীয় উৎপাদিত গ্যাস মোট সরবরাহের ৬৬% বা দুই-তৃতীয়াংশ, আমদানি করা হচ্ছে মোট সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশ।
দেশীয় ক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস দুই উৎস থেকে পাইপলাইনে যুক্ত হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানির মাধ্যমে ৭৯১ ইউনিট। বাকিটা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির মাধ্যমে ১২২৪ ইউনিট।
আন্তর্জাতিক দুটি কোম্পানি যে ১২২৪ ইউনিট গ্যাস সরবরাহ করে এর মধ্যে শেভরন কোম্পানির অধীনস্থ তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১১৯১ ইউনিট, যার মধ্যে বিবিয়ানা একাই সরবরাহ করে ১০১৬ ইউনিট। অপর কোম্পানি তাল্লুর অধীনস্থ একটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা হয় ৩৩ ইউনিট।
দেখা যাচ্ছে, দেশের বর্তমান মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৩৩ শতাংশ আসে শেভরন অধীনস্থ বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড থেকে। সমীক্ষা অনুযায়ী এই ক্ষেত্রের যে পরিমাণ উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুত ছিল তা নভেম্বর ২০২৩ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
নভেম্বর ২০২৩-মে থেকে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে (১০১৬ ইউনিট যা মোট সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশ) তা সমীক্ষায় প্রমাণিত মজুতের বাইরে বা এক কথায় বোনাস। এই সরবরাহ যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র বন্ধ হলে আমাদের দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলনকৃত গ্যাস সরবরাহ থাকবে ৯৯৯ ইউনিট। তখন চাহিদার বিপরীতে মোট ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ৭৫ শতাংশ।
অর্থাৎ বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড থেকে সরবরাহ বন্ধ হলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে মোট গ্যাস চাহিদার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পূরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন দ্বারা আমাদের বর্তমান চাহিদার মাত্র এক-চতুর্থাংশ বা সিকি ভাগ পূরণ সম্ভব হবে।
আমরা বর্তমানে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করি ভবিষ্যতে তার প্রায় তিন গুণ এলএনজি আমদানির করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে বর্তমান এলএনজি আমদানি ব্যয়ের প্রায় তিন গুণ অর্থ। একই সঙ্গে বাস্তবতা হলো- সে এলএনজি আমদানি করে খালাস ও সরবরাহ লাইনে দেওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব হবে না।
বর্তমানে দেশে গ্যাস উত্তোলনের রাষ্ট্রায়ত্ত ও আন্তর্জাতিক যত কোম্পানি কাজ করছে তাদের উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত আনুমানিক ৮.৫ টিসিএফ। আমাদের ক্রমবর্ধমান যে চাহিদা তাতে এই পরিমাণ মজুত আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। যদি এই সময়ের মধ্যে নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও উত্তোলন শুরু না হয় সেক্ষেত্রে আমাদের গ্যাসের চাহিদার সম্পূর্ণ অংশ আমদানি করতে হবে। অর্থাৎ জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের চাহিদার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই আমদানিনির্ভর হতে যাচ্ছে- বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমনটাই আশঙ্কা করা যায়। সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে।
২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত গ্যাস ক্রয় বাবদ মোট পরিশোধ করতে হয়েছে ১,১০,৭০৩ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রায়ত্ত উত্তোলন কোম্পানিগুলো আমাদের মোট গ্যাসের চাহিদার ২৬ শতাংশ পূরণ করে। কিন্তু মূল্য হিসাবে নেয় গ্যাস ক্রয়ের জন্য মোট যে খরচ, তার মাত্র ৫.২৫ শতাংশ (৫,৮২৮ কোটি টাকা)। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক গ্যাস কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ, কিন্তু তারা মূল্য নেয় মোট ব্যয়ের ১৭.৩৮ শতাংশ (১৯,২০৮ কোটি টাকা)। আমদানিকৃত এলএনজির মাধ্যমে পূরণ হয় মাত্র ৩৪ শতাংশ, কিন্তু তার জন্য ব্যয় হয় সবচেয়ে বেশি, যা মোট ব্যয়ের ৭৭.৩৭ শতাংশ (৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা)। বিভিন্ন উৎস থেকে গ্যাস ক্রয় বাবদ খরচের ও সরবরাহের পরিমাণকে সরলীকরণ করলে নিচের ফলাফল পাওয়া যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানির ১ ইউনিট গ্যাসের মূল্য পরিশোধে যে টাকা খরচ হয়, সমপরিমাণ দেশে উত্তোলিত বিদেশি কোম্পানির গ্যাসের দাম পরিশোধে খরচ হয় ২.১৪ গুণ বেশি অর্থ এবং আমদানিকৃত সমপরিমাণ এলএনজি দাম পরিশোধে খরচ হয় প্রায় ১১.২ গুণ বেশি টাকা।
দেশে উৎপাদিত গ্যাসের মূল্য প্রতি ইউনিট (মিলিয়ন বিটিইউ বা ১০০০ কিউবিক ফিট গ্যাস) ১-৩ ডলার। আমদানিকৃত এলএনজির মূল্য পরিশোধ করতে হয় ১২-৪০ ডলার পর্যন্ত (দীর্ঘমেয়াদি ক্রয়চুক্তির ক্ষেত্রে ১২ ডলার এবং স্পট মার্কেটের মূল্য ৩৫-৪০ ডলার)। অর্থাৎ দেশে উৎপাদিত গ্যাসের খরচের তুলনায় আমদানিকৃত এলএনজির খরচ ৪-১৫ গুণ পর্যন্ত বেশি করতে হয়। আমাদের গ্যাসের চাহিদা আছে। সাধ্য অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহের পরও প্রতিটি সেক্টরে বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী ঘাটতি আছে যথেষ্ট পরিমাণে। আমরা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, অন্যান্য গ্যাসভিত্তিক শিল্প ও বিভিন্নভাবে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি করে চলেছি।
এমন প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, কেন আমরা আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য দেশে উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছি না। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের লভ্যতা বা উৎপাদনের সম্ভাব্যতা কি নেই?
২০০১ সালে ইউএসজিএস এবং পেট্রোবাংলা পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত সম্পর্কে এক যৌথ জরিপ পরিচালনা করে। তাদের তথ্যমতে, এই এলাকাগুলোতে সম্ভাব্য গ্যাসের মজুত ৩২ টিসিএফ। আবার ২০১৮ সালে একই এলাকায় ডেনমার্কের কোম্পানি জরিপ পরিচালনা করে এবং ৩৪ টিসিএফ প্রাকৃতিক গ্যাস মজুতের আভাস দেয়। অর্থাৎ পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে ৩২-৩৪ টিসিএফ গ্যাসের মজুত আছে।
দেশীয় নতুন গ্যাসক্ষেত্রসমূহে গ্যাস মজুত আছে বলে বিশেষজ্ঞদের জরিপে জানা যায়। কিন্তু আমরা অনুসন্ধান ও উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছি না। কায়েমি স্বার্থবাদীদের সুবিধা দিতে আমদানিতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সে উদ্দেশ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদনে অনাগ্রহ দেখানো হচ্ছে। এরকম একটি অভিযোগ প্রায়শই বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যায়। এ বিষয়ে যে কোনো সত্যতা নেই, সেটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো জোরালো যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলোর গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের অভিজ্ঞতা এবং সক্ষমতার বিষয়ে কিছু তথ্য নিচে দেওয়া হলো। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানিগুলো ১৮টি গ্যাস অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। এর জন্য ব্যয় করেছে ৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। গ্যাস পেয়েছে ৯টি কূপে। সফলতার হার ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গ্যাস কোম্পানি ৫৬ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করে ৮টি কূপ খনন করেছে। গ্যাস পেয়েছে দুটি কূপে। সফলতার হার ২৫ শতাংশ।
অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পরিচালিত গ্যাস অনুসন্ধানের খরচ এক্ষেত্রে নিয়োজিত বিদেশি কোম্পানিগুলোর তুলনায় কম। অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সফলতার হার দেশীয় কোম্পানির বেশি। আগেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পনির উৎপাদিত গ্যাসের মূল্যও সবচেয়ে কম। রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানিগুলোকে গ্যাস অনুসন্ধানে ও উৎপাদনে আরও বেশি সক্রিয় করা বাঞ্ছনীয় ছিল বলা যায়। এক্ষেত্রেও কায়েমি স্বার্থবাদীদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস এখন আমাদের জ্বালানির একটি সিংহভাগ দখল করে আছে। কিন্তু এর লভ্যতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সামনের দিনগুলোতে এ অনিশ্চয়তা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন দেশীয় গাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলন ও ব্যবহারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সুযোগ সৃষ্টি অত্যাবশ্যক মনে করি। এর মাধ্যমেই শুধু ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা শক্তিশালী করা সম্ভব।
লেখক : বিরোধীদলীয় নেতা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ