বিশেষ সাক্ষাৎকারে জি এম কাদের
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তবে জি এম কাদের নামেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি পরিচিত। প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও দেশের মানুষের কাছে রাজনীতিবিদ হিসেবেই পরিচিত লাভ করেছেন। সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। শুক্রবার সকালে তার উত্তরার বাসভবনে সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যায়যায়দিনের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন ফয়সাল খান
যায়যায়দিন : জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করছে, আবার সরকারের সঙ্গেও সখ্য। এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। আপনি কী বলবেন?জি এম কাদের : আমরা শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় যেতে চাই। পার্টির স্বকীয়তা থাকবে। সব পর্যায়ে আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও রাজনীতি স্পষ্ট করতে চাই। পার্টির শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চাই।
আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছি। আমরা কিন্তু সরকারের অংশ হইনি। আমাদের কোনো মন্ত্রীও নেই।যাযাদি : বিরোধী দলের চেয়ারম্যান হিসেবে আপনি সম্প্রতি সরকারের সমালোচনা করে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন; কিন্তু সংসদে আপনাদের দলের সংসদ সদস্যদের বক্তব্য উল্টো। ব্যাপারটা সাংঘর্ষিক কি না?
জি এম কাদের : সবাই নয়, দু-একজন সংসদ সদস্যের ব্যাপারে এমন অভিযোগ আছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নেব। ভবিষ্যতে এসব চলবে না। সংসদে দু-একজন ছাড়া সবাই ভালো কথা বলছেন। সরকারের বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে স্বোচ্চার হয়ে কথা বলছেন। বিভিন্ন বিলের ওপর স্বাধীন মতামত দিচ্ছেন।
যাযাদি : আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সম্পর্কটা কী?
জি এম কাদের : এটা নিয়ে কনফিউশন আছে। ইলেকশনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে অ্যালায়েন্স হয়নি। আন্ডারস্ট্যাডিং হয়েছিল। কজে সেভাবে তখনও আমরা মহাজোটে ছিলাম না। কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতা ছিল, কিছু ক্ষেত্রে দুই দলের প্রার্থী ছিল। যেহেতু নির্বাচনের সময় কিছুটা হলেও সমঝোতা ছিল, সেখানে আমাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা সুস্পষ্ট ছিল।যাযাদি : তাহলে জাতীয় পার্টি এখন মহাজোটে নেই?
জি এম কাদের : হঁ্যা, আমরা মহাজোটে নেই।
সরকার গঠনের পর যখন জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলো তখন থেকে আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। তখন থেকে আমরা বিরোধী দল। মহাজোট তো প্রশ্নই আসে না। অন্য কোনো সমঝোতার মধ্যেও আমরা নেই।যাযাদি : বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি কী ভূমিকা পালন করতে চায়?
জি এম কাদের : আমরা আইন সভায় সরকারকে গঠনমূলক প্রস্তাব দিতে পারি। সমালোচনা করতে পারি; কিন্তু এর বাইরে সংসদের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করার ক্ষমতা বিরোধী দলের নেই। ১৯৯১ সালের পর থেকে যত বিরোধী দল ছিল তারা আমাদের চেয়ে কম কার্যকর ছিল। কেননা তারা বেশিরভাগ সময় সংসদে ছিলেন না। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় তখন বিএনপি ছিল না। বিএনপি যখন ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগ ছিল না। ফলে তারা সরকারকে এক প্রকার ওয়াকওভার দিয়ে দিয়েছিল। কোনো প্রকার বাধা ছাড়া সরকারকে সবকিছু করতে দিয়েছে বিরোধী দলগুলো। সত্যিকার অর্থে বাধা আমরাও দিতে পারি না; কিন্তু চেষ্টা করি। কিন্তু তারা চেষ্টাও করেননি, সংসদ থেকে সরে গেছেন। সে অর্থে আমরাই সংসদে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করছি।
যাযাদি : সংসদের পাশাপাশি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে রাজপথে জাতীয় পার্টির কী ভূমিকা থাকবে?
জি এম কাদের : শুধু আমরা না, আমাদের আগে যারা ছিলেন তারাও রাজপথে আন্দোলন করে সরকারের বড় ধরনের কোনো ব্যাঘাত ঘটানো বা পতন ঘটাতে পারেনি। ২০১৩-১৪ সালে মাসের পর মাস আন্দোলন করে, দেশ অচল করেও সরকারের কোনো সমস্যা হয়নি। বরং সাধারণ জনগণের অসুবিধা হয়েছে।
জনগণ এগুলো পছন্দ করছে না, সমর্থন করে না। ফলে এখন কোনো দলই রাজপথে আর থাকতে পারছে না বা থাকছে না। কোনো দলই এখন আর রাজপথের কর্মসূচিতে সক্রিয় নয়। সভা সমাবেশ, মানববন্ধন ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমাদের বক্তব্যগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরে জনমত গঠনের চেষ্টা করছি।
যাযাদি : সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সম্পর্কে আপনার মত কী?জি এম কাদের : একনায়কতন্ত্র যখন থাকে, জবাবদিহিতা তখন থাকে না। তখন সরকারি দল দলীয়করণ ও দুর্নীতির মাধ্যমে সব জায়গায় চেপে বসে। ফলে মানুষে মানুষে বৈষম্য, অনাচার, অবিচার বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যাযাদি : বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
জি এম কাদের : দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতার কারণে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন আর রাজনীতিতে আসতে চান না। রাজনৈতিক দলগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। ৩০-৪০টা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২/৩টার বেশি চোখে পড়ে না। অন্য দলগুলোর কোনো কর্মকান্ড নেই।
যাযাদি : দেশের রাজনীতির এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো বলে আপনি মনে করেন?জি এম কাদের : যখন কেউ মনে করে এই নির্বাচনে গিয়ে আমার কোনো লাভ হবে না। মানুষ ভোট দিতে আসবে না। তখন আর কেউ মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাবে না।
নির্বাচন করতেও চাইবে না। কেউ সংগঠন গড়বে না। মানুষও রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে উৎসাহ পাবে না। নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ থেকে রাজনীতি হারিয়ে যাচ্ছে, রাজনীতিবিদ হারিয়ে যাচ্ছে।
যাযাদি : দেশের সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আপনার অভিমত কী?জি এম কাদের : কিছু বিষয়ে মানুষের ধারণা পরিষ্কার নয়। ১৯৯১ সালের পর থেকে সাংবিধানিকভাবে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। সেখানে নির্বাহী বিভাগের প্রধানকে, শুধু নির্বাহী বিভাগের প্রধান নয়, সংবিধানের ৭০ ধারা সংশোধনের মাধ্যমে আইনসভা সম্পূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণে, একই সঙ্গে বিচার বিভাগের অধঃস্তন আদালতগুলোকে সম্পূর্ণভাবে তার অধীনস্ত করা হয়েছে। এক ব্যক্তির হতে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যেটাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না।