চলমান রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি। ওই একান্ত আলাপচারিতায় দলের ভেতরে সাম্প্রতিক সংকটসহ উঠে এসেছে আরও অনেক বিষয়। তার সঙ্গে কথা বলেন স্টাফ রিপোর্টার মুহম্মদ আকবর
শুরুতেই কথা হয় জাপায় ভাঙন বা বিভক্তি নিয়ে। এ কারণে দলের অভ্যন্তরে সংকট বাড়ছে কিনা, এমন প্রশ্নে জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো ভাঙন নেই। কিছু মানুষ নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তারা একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চাইছেন। এটা জাতীয় পার্টি হচ্ছে না। কেননা আইনগতভাবে কাউন্সিলের মাধ্যমে আমাদের একটা গঠনতন্ত্র তৈরি করা আছে। সেই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী লিডারশিপ তৈরি করা হয়েছে। আইনের ধারাবাহিকতায় ইলেকশন কমিশনও আমাদের গ্রহণ করেছে। কাজেই এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে আরেকটা জাতীয় পার্টি গঠন করার কোনো সুযোগ নেই।তিনি বলেন, অন্য দল যে কোনো লোক করতে পারে। এতে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন নয়। জাতীয় পার্টি থেকে যদি কিছু লোক চলে যায় বা আমরা যদি কোনো কারণে বের করে দিই, তা হলে তা দলের ভাঙন হবে না। জাপার নেতাকর্মী বা সমর্থকরা আমাদের সঙ্গে আছে ও থাকবে। তিনি যোগ করেন, কিছু সমস্যা যে কোনো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে থাকতে পারে; কিছু সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টাও চলে। আমরা সেটাকে জীবনের বা রাজনীতির অংশ হিসেবে ধরে নিই। কারণ সমস্যা ছাড়া তো জীবন নেই।জাপার প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে তৃণমূলে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করা হচ্ছে। এ তথ্য তুলে ধরে জিএম কাদেরের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, যারা এ কমিটিতে যাবে, তাদের বহিষ্কার করা হবে কিনা? তিনি বলেন, এটা স্বাভাবিক যে একসঙ্গে দুটো দল করা যাবে না। আমাদের ৩০০টি সংসদীয় আসন। প্রতিটি আসনে ৩ লাখেরও বেশি ভোটার। সেক্ষেত্রে দু-চারজন কোথাও গেলে আমাদের কিছু যায়-আসে না।
কিছু মানুষকে যখন দলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে তখন দলেরই কিছু নেতাকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। বিষয়টি কেমন দেখায়? জবাবে জিএম কাদের বলেন, এটা তো খুব স্বাভাবিক বিষয়। আমার দৃষ্টিতে যাদের প্রয়োজন নেই বলে মনে হচ্ছে কিংবা যারা মনে করছে এই দলে তাদের ভালো লাগছে না, তারা চলে যাবে। আবার কারও যদি মনে হয় জাতীয় পার্টিতে আসবেন, আমরা তাদের গ্রহণ করছি। এভাবেই তো রাজনৈতিক দল সমৃদ্ধ হয়।
নির্বাচনকে সামনে রেখে জাপায় পারিবারিক দ্বন্দ্ব বেশি হয় বলে অনেকে মনে করেন। এটা দ্বন্দ্ব নাকি পার্টির রাজনৈতিক কৌশল? জবাবে জিএম কাদের বলেন, কিছু লোক ওনাকে (রওশন) ব্যবহার করছেন। যারা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, অনেক দিন ধরে দলে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না, তারা অনেকেই ওনার বার্ধক্য বা অসুস্থতাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। তাকে সামনে রেখে একটা ষড়যন্ত্র করছেন। এমনটিই ধারণা করছি। সেক্ষেত্রে সব স্পষ্ট করতে রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল কিনা? তিনি বলেন, আমি করিনি। করতে পারিনি। কারণ তখন আমার ফোন নষ্ট ছিল। আর এখন ওনাকে পাওয়াই যাচ্ছে না। ফোনে ওনাকে পেতে হলে আরেকজনের মাধ্যমে পেতে হয়। সেই আরেকজনের কাছে চাইলে তাকে (রওশন) দিচ্ছেন না।
রওশন এরশাদ যে বার্তা দিচ্ছেন, সেটা ওনার নয়। এমন ধারণা কীভাবে হলো? এমন প্রশ্নে জিএম কাদের বলেন, উনি অনেকবার আমাকে বলেছেন আমি আর রাজনীতি করব না। তোমাকে পছন্দ করি। তুমিই ভালো চালাচ্ছ। কেউ কোনো কথা বললে বিশ্বাস করবে না। আমি সব সময় তোমার সমর্থনে আছি।
২০১৪ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল করার প্রস্তাব করা হয়েছিল; এবারও করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। আবেদনের ত্রুটিতে নাকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা কিংবা সরকারের প্লান? কেন এমন হচ্ছে? তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। তাই কিছু বলতে পারব না। কমপ্লিট কোনো ধারণা না নিয়ে তো কিছু বলা যায় না।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে অংশ নেবে কিনা এমন প্রশ্নে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, সে সময়ের পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেব। এখন পর্যন্ত এককভাবে নির্বাচন করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছে দল। সব বড় রাজনৈতিক দলই এককভাবে চিন্তা করে। আমাদের বেলায়ও তা-ই।
এমন গুঞ্জনও রয়েছে যে, জাপা বিএনপির সঙ্গে যাবে- এ কথায় হাসলেন জিএম কাদের। এরপর বলেন, আমরা এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আর কে কী বলল, তা নিয়ে কিছু বলতে পারব না। আমরা যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেব, তখন নিশ্চয়ই বলব।
কিছুদিন আগে দৈনিক আমাদের সময়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, তাতে জোটের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম। তার মানে কী জোটের দিকেই শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে জাতীয় পার্টি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা আমি শুধু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেই বলিনি। বলেছিলাম নির্বাচন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এ রকম ব্যবস্থা যেখানে আছে, সেখানে শেষ পর্যন্ত দুটো জোট বা দুটো দল হয়ে যায়। অবশিষ্ট দলগুলো টিকতে পারে না। ভারতেও এমনটা আছে। তবে সেখানে যেহেতু ফেডারেল গভর্মেন্ট, তাই রাজ্যগুলোতে কিছু দল দাঁড়িয়ে আছে। তা ছাড়া বৃহদাকার দুটো দলই আছে সেখানে বিজেপি আর কংগ্রেস। ইংল্যান্ডে যেমন আছে লেবার পার্টি আর কনজারবেটিভ পার্টি; আমেরিকায় যেমন রিপালিকান আর ডেমোক্রেট।
জাপা এককভাবে নির্বাচনে গেলে দলের জন্য তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে? তিনি বলেন, নির্বাচনের তো আরও এক বছর বাকি। জাতীয় পার্টি যেহেতু জাতীয় পর্যায়ের অন্যতম দল, সেহেতু ৩শ আসনের প্রতিটিতে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন এলে যদি আমাদের রাজনীতি সেভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, যদি মনে হয় এককভাবে প্রার্থী দিলে জয়ী হবেন, তা হলে তা-ই করব।
ইভিএম নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করার পরও স্থানীয় নির্বাচনে গেছে জাপা। এ বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, আমরা সব সময় বলেছি ইভিএম নিয়ে কারচুপির সুযোগ আছে। আমাদের কথা প্রমাণিত হয়েছে। ইভিএম মেশিন ঠিক থাকলেও আমাদের দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের কারণে ইলেকশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই সরকারের প্রভাবের অধীন। এমন পরিস্থিতিতে ইভিএম হলেও সরকারি দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পাস করা খুবই কঠিন। তারা খুবই কৌশলী হয়ে ম্যানিপুলেট করতে পারবে। কোনো ডকুমেন্টও থাকবে না পরে চ্যালেঞ্জ করার জন্য। এজন্য আমরা এটার বিরোধিতা করেছি। ইভিএম পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে যাব কিনা, তা আমাদের দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। নির্বাচনের আগে দলের সব স্তরে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত যে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তা যে পদ্ধতিতেই হোক আর যেমনই হোক। কারণ নির্বাচনে অংশ না নিলে বুঝতে পারব না- নির্বাচনে কীভাবে ও কতটা কারচুপি হচ্ছে।
আপনারা বিএনপির মতোই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে কর্তৃত্ববাদী সরকার বলছেন। এ কথা বলতেই জিএম কাদের বলেন, আমরা আগে বলেছি। তারপর বিএনপি বলছে।
বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেছে। আপনারাও নামবেন কি? এমন প্রশ্নে জিএম কাদের বলেন, সরকার পতনের আন্দোলনে নামার মতো সাংগঠনিক বা অর্থনৈতিক শক্তি আমাদের নেই। কিন্তু আমরা মনে করি, এখন যা হচ্ছে তা জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা নয়। এই সরকারব্যবস্থা ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করছে। বেশিরভাগ মানুষের স্বার্থ লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপনারা কি সরকারের পতন চান? জিএম কাদের বলেন, আমরা সরকারের পতন নয়, পরিবর্তন চাই।
জাপা থেকে সদ্য বহিষ্কৃত মশিউর রহমান রাঙা বলেছেন, জাতীয় সংসদে আপনার যে চেয়ার আছে তা কেড়ে নেওয়া হবে। এ কথায় কিছুক্ষণ হেসে তিনি বলেন, অনেকেই অনেক রকম কল্পনা করতে পারেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। হা হা হা।https://www.dainikamadershomoy.com/post/403648