মত-মতান্তর | স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন | জি এম কাদের
কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এই বক্তব্য নিয়ে কোন সংশয় থাকা উচিত নয়। কিন্তু দেখা গেছে যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রেক্ষাপটের বাইরে গিয়ে কিছু সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল বারবার এমন বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে। মজার ব্যাপার হলো, তারা নিজেদের কোনো উদ্দেশ্য সাধনেই এমনটি করে থাকে বলে জানা গেছে। তারা সে উদ্দেশ্য সাধনে বাস্তবতাকে কিছুটা হলেও বিকৃত করার দিকে ঝোঁকেন। তারা চান, সবাই এটা মেনে নিক যে, একই নেতৃত্বে বর্তমান সরকার একটানা ক্ষমতায় থাকার নামই স্থিতিশীলতা। যেমন, বর্তমান নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকা দেশের মঙ্গল বা উন্নয়ন নিশ্চিত করে। সুতরাং, তাদের মতে, কিভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে হয় সে বিষয়টি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এভাবে ‘অনিয়মিত’ পন্থা অবলম্বন করেও একই নেতৃত্বে বিদ্যমান সরকারের ধারাবাহিকতাকে ন্যায্যতা দিতে উপরোক্ত বক্তব্যটিকে ব্যবহার করা হয়।স্থিতিশীলতা মূলত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সামাজিক সম্প্রীতির জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশের নামই স্থিতিশীলতা।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুশাসনের (আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার) উপর ভিত্তি করে একটি দেশে স্থিতিশীলতা থাকে। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার সঙ্গে কার্যকর রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি সরকার এবং তার নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ইচ্ছার জন্ম তখনই হয় যখন সে জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকে। জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে নিজেদের কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত করতে এ ধরনের সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, অন্যথায় ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই চাপ শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সুশাসনের দিকে নিয়ে যায়।এ ধরণের পরিস্থিতিতে, সরকার, বিশেষ করে সরকার প্রধান সাধারণত দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। কখনও কখনও শাসনব্যবস্থাটি এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে কোনো নেতা নির্দিষ্ট সময়সীমার বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। সরকার প্রধানকে কর্তৃত্ববাদী শাসক হওয়ার জন্য খুব বেশি সময় না দিতেই এমনটি করা হয়।
ইতিহাস বলে, সবসময়ই এমন একটি সম্ভাবনা থেকে যায়।অন্যথায়, সরকার বা তার নেতৃত্ব পরিবর্তনের সুযোগ থাকলে জনগণ আরো ভাল কোনো বিকল্পের সন্ধান করে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, সরকার বা নেতৃত্বের পরিবর্তন কোনোভাবেই স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করবে না। সুতরাং, একটি দেশের জন্য স্থিতিশীলতার পরীক্ষা হল – সরকার বা নেতৃত্বে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসলেও সে তার প্রতি সংবেদনশীল হবে না।প্রকৃতপক্ষে, নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন ছাড়া একই সরকারের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে না। এ ধরনের স্থিতিশীলতাকে বড়জোর কৃত্রিম এবং/অথবা ভাসা-ভাসা বলা যেতে পারে। ক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন হলে এমন স্থিতিশীলতা বড় এবং/অথবা সহিংস ব্যাঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যে সরকার এবং/অথবা নেতৃত্ব যে কোনও উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে চায় তাদের সুশাসন প্রদানের অভিপ্রায় বা সক্ষমতা থাকবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। বিপরীতে, এ ধরনের সরকার এবং এর নেতৃত্ব সাধারণত দুর্নীতির চর্চায় লিপ্ত হয়ে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য পূরণের একটি গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রোনিজমের (যথাযথ বিবেচনা না করে দায়িত্বশীল পদে নিকটজন ও সহযোগীদের নিয়োগ দেওয়া) পক্ষে থাকে।তারা সমাজে বৈষম্য ও বঞ্চনা প্রতিষ্ঠা করে, দমনমূলক ব্যবস্থা ব্যবহার করে এবং যেকোনো অসন্তোষ মোকাবিলায় হতাশা ও সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে। এসব করতে সক্ষম হওয়ার জন্য, এ ধরনের সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়ে কোনো না কোনোভাবে সব কর্তৃপক্ষকে কেন্দ্রীভূত করে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ স্বাধীন কর্তৃত্ব হারায় এবং সরকার প্রধানের অধীনস্থ হয়। সমগ্র শাসন ব্যবস্থা একটি একক কেন্দ্রীয় বিন্দু অর্থাৎ সরকার প্রধানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এটি শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। এটা অনেক স্তম্ভের পরিবর্তে একটি একক স্তম্ভ দ্বারা নির্মিত কোনো বড় কাঠামোরই অনুরূপ। ওই স্তম্ভের কিছু হলে গোটা কাঠামোটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কোনো কারণে ওই স্তম্ভটি ভেঙে পড়লে কাঠামোটিও (যতো মজবুতই মনে হোক না কেন) ভেঙে পড়ে। যা এ ধরনের সরকারকে অস্থিরতায় ফেলে এবং পরিবর্তন হলে গুরুতর এবং সহিংস পরিণতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।’একটি দেশের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা আবশ্যক’ ওই প্রাথমিক বক্তব্যে ফিরে আসলে দেখা যায় যে শুধু ‘স্থিতিশীলতা’ শব্দটিই নয়, ‘উন্নয়ন’ শব্দটিরও ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যারা ‘স্থিতিশীলতা’ শব্দটির অর্থের ভুল ব্যাখ্যা দেয় তারা ‘উন্নয়ন’-এর ক্ষেত্রেও একই কাজ করে। উন্নয়নকে শুধুই ‘অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ বলে থাকে। এটিও একটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে করা হয়- নেতা এবং সরকারের কার্যকারিতাকে মহিমান্বিত করা এবং শেষমেশ ক্ষমতায় থাকার ন্যায্যতা দেওয়া। উপরন্তু, তারা সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে নিজেদের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা আদায় করতে নিজেদের ধরনের ‘উন্নয়ন’কে ব্যবহার করে। কিন্তু ‘অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ উন্নয়নের একটি অংশ বা উন্নয়নকে সাহায্য করার একটি উপায় মাত্র। এগুলো সত্যিকারের উন্নয়ন নয়। প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়ন বলতে একটি দেশের গড় নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উন্নতিকে বোঝায়।দেশের উন্নয়নের জন্য সাধারণত অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়। কিন্তু, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের জীবনযাত্রায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না, এমন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কোনোভাবেই উন্নয়নের সহায়ক নয়। এমন অবকাঠামোগত উন্নয়নকে উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিবেচনা করাও উচিত নয়। কখনও কখনও, অবকাঠামোগত উন্নয়ন আর্থিক বোঝা হয়ে উঠে এবং প্রকৃত উন্নয়নের বিপরীতে অনাকাঙ্ক্ষিত ফল নিয়ে আসতে পারে।উন্নয়নের নামে অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রায়ই সেগুলোর সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করার অভিযোগ উঠে। সরকারি কোষাগার থেকে কিংবা স্থানীয়ভাবে এবং/অথবা বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বড় ধরনের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। বাস্তবায়নকালেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। অনেক সময় বাজেট ছাড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অবকাঠামোর খরচ সুবিধাকে ছাড়িয়ে যায়। সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা কোনো উন্নতি না হওয়ার বদলে তারা ঋণের ভারী বোঝা বহন করেন।কোনো সরকার বা ব্যক্তি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় অব্যাহত থাকলে সেটা স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে না। বরং, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ঝুঁকি তৈরি করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সবসময় প্রকৃত উন্নয়নের নিশ্চয়তা দেয় না। প্রকৃত অর্থে দেশের উন্নয়ন মানে সাধারণ নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন। যথাযথ জবাবদিহিতা ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন দুর্নীতির দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং এতে প্রকৃত উন্নয়নের বিপরীত পরিণতি হতে পারে।[লেখকঃ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা]
Article LInk: